বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শনিবার মধ্যরাতে মাস্ক ও হেলমেটধারীদের হামলার পর থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই-বাংলা ও বঙ্গবন্ধু হলে হামলা করে ছাত্রলীগের এক পক্ষকে তাড়িয়ে হল দুটির নিয়ন্ত্রণ নেয় আরেকটি পক্ষ। হামলা করা পক্ষটি বর্তমানে হলে আধিপত্য ধরে রেখেছে। অন্য পক্ষটি বাইরে অবস্থান করছে। এখন বাইরে থাকা পক্ষটির হামলার আতঙ্কে আছেন হল দুটির আবাসিক শিক্ষার্থীরা।
সোমবার শের-ই-বাংলা ও বঙ্গবন্ধু হলের অন্তত সাতজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেন, শনিবার রাতের ঘটনার পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর গত ১২ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। অথচ গত পাঁচ বছরে ছাত্রলীগের নামে একেক পক্ষ নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য বিভিন্ন সময় সংঘাতে জড়াচ্ছে। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব দমনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে প্রক্টর মো. খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনার পর তাঁরা যথেষ্ট তৎপর। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। হলগুলোতে শান্তি ফেরাতে বৈধ শিক্ষার্থী ছাড়া অন্যদের হল ত্যাগের জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের আতঙ্ক দূর করতে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে হলে গিয়ে তাঁদের আশ্বস্ত করা হচ্ছে।
মধ্যরাতে হামলা করে হলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা পক্ষটি বরিশাল সিটির বিদায়ী মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘদিন হলগুলো তাঁদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে সিটি নির্বাচনে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ জিতে যাওয়ায় তাঁরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। এ সময় হলগুলো পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের অনুসারী হিসেবে পরিচিত পক্ষটি নিয়ন্ত্রণ নেয়। নির্বাচনের দেড় মাসের মধ্যেই শনিবার রাতে মাস্ক-হেলমেট পরে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আবার হল পুনরুদ্ধারে আসেন সাদিকপন্থীরা।
শিক্ষার্থীরা জানান, দুটি হলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ছাত্রলীগের পক্ষটির বিরুদ্ধে ঘটনার প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে প্রশাসন কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উপরন্তু নিয়ন্ত্রণ নেওয়া পক্ষটি রোববার দুপুরে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করছে। সমাবেশ থেকে হামলার শিকার পক্ষটিকে গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করে প্রশাসনকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাঁরা বলেন, হামলা করা পক্ষটির বেশ কয়েকজন নেতা বঙ্গবন্ধু হলে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁরা রোববার রাতে হলের মূল ফটকে আড্ডার নামে পাহারায় ছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শের-ই-বাংলা হলের অন্তত ছয় শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের পক্ষগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষের সমর্থক বলে মনে করে, এমন সন্দেহে অনেক শিক্ষার্থীকে হলে নির্যাতন করা হয়েছে। গত ১ এপ্রিল শের-ই-বাংলা হলের এমন তিন শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হন। আরেকটি পক্ষের সমর্থক ও খবর সরবরাহকারী মনে করে তাঁদের ওপর একটি পক্ষ নির্যাতন করে।
এদিকে হামলার ঘটনায় আজও কোনো মামলা হয়নি। বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুর রহমান বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় কোনো পক্ষ এখনো মামলা করেনি বা লিখিত অভিযোগ দেয়নি। ক্যাম্পাসের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দুটি হলে পুলিশি পাহারা আছে।
হামলার শিকার পক্ষটির নেতা অমিত হাসান ওরফে রক্তিম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত আছেন। মামলার প্রস্তুতি চলছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ক্যাম্পাসে কখনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দিইনি; শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করেছি। হলের নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি থেকে আমরা সব সময় দূরে ছিলাম। অবশ্যই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করার জন্য আমরা ক্যাম্পাসে যাব।’
অন্যদিকে নিজেরাই হামলার শিকার দাবি করে সাদিক আবদুল্লাহপন্থী মাহামুদুল হাসান ওরফে তমাল বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো অছাত্রদের দখলে ছিল। শনিবার রাতে সাধারণ ছাত্ররা প্রতিবাদ করতে গেলে হামলার শিকার হন। সেখানে আমাদের চার থেকে পাঁচজন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। বর্তমানে ক্যাম্পাস অছাত্রমুক্ত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।’
ছাত্রলীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাঁচ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বিবদমান পক্ষের মধ্যে সংঘাত ও হামলার ঘটনায় বন্দর থানায় অন্তত ১০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে লঘু অপরাধের একটি মামলায় পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে। দুটি মামলার মীমাংসা হয়েছে। অন্য মামলাগুলোর এখনো অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
শনিবার মধ্যরাতের হামলার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি পক্ষের বিরুদ্ধে ইন্ধনের অভিযোগ করেছেন হামলার শিকার প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের অনুসারী অমিত হাসান ও ময়ীদুর রহমানের সমর্থকেরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই পক্ষের তিনজন ছাত্রলীগ কর্মী বলেন, কয়েক দিন আগে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে উপাচার্যের কাছে ১৭ দফা দাবি পেশ করেন তাঁরা। দাবি পূরণে এক মাসের আলটিমেটাম দেওয়া হয়। এতে প্রশাসনের একটি প্রভাবশালী পক্ষ মনে করছে, তারা (ছাত্রলীগের একটি পক্ষ) ক্যাম্পাসে থাকলে দাবিদাওয়া নিয়ে প্রশাসন চাপে থাকবে। এ জন্য তাঁদের ক্যাম্পাস থেকে দূরে রাখতে হামলাকারী পক্ষটিকে তারা ইন্ধন দিচ্ছে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইন্ধনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রক্টর খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, শনিবার রাতের ঘটনা শোনামাত্র তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েছেন। শিক্ষকেরা ঝুঁকি নিয়ে দুই পক্ষকে নিবৃত্ত করেছেন। এ ছাড়া তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে কমিটি করা হয়েছে। এরপরও কোনো পক্ষ প্রশাসনের বিরুদ্ধে ইন্ধনের অভিযোগ করলে, সেটা সম্পূর্ণ অমূলক, অযৌক্তিক এবং দুঃখজনক।