সরকার পতনের পর দুটি গ্রামে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ওঁরাওদের ওপর হামলা হয়েছে। তাঁদের বসতবাড়ি ভাঙচুর, আগুন এবং আমের বাগান কেটে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এখনও তাঁদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ঘটনার দুই সপ্তাহ পরও তাঁদের আতঙ্ক কাটেনি। পুরুষ সদস্যরা অনেকেই এলাকাছাড়া, নারীরা ঘর থেকে তেমন বের হচ্ছেন না।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জমি দখল করতে দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের ওপর হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সরকার পতনের সুযোগে আবার বাড়িঘরে হামলা ও আগুন দেওয়া হয়েছে; কেটে দেওয়া হয়েছে আমের গাছ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার ধাওয়াকান্দর গ্রামে ৫ আগস্ট রাতে ওঁরাও পরিবারের একটি বাড়িতে আগুন ও চারটি বাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ওই গ্রামের ৬০টি পরিবারের মধ্যে ৩০টি ওঁরাও পরিবার। এর পাশে ৮ আগস্ট রাতে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ইকারাপাড়ার ওঁরাও পরিবারের প্রায় ৩ বিঘা জমির ৫৩০টি আমগাছ কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা। এখানে ৭৭টি পরিবার রয়েছে যার মধ্যে ৪৮টি ওঁরাও পরিবার।
ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নেতা বঙ্গপাল সরদারকে সঙ্গে নিয়ে গত বৃহস্পতিবার সকালে নিয়ামতপুরের ইকরাপাড়া গ্রামে যান এ প্রতিবেদক। বাড়িতে পুরুষ সদস্যরা নেই। কয়েক নারী বাড়ি থেকে বেরিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আমবাগানে নিয়ে যান। কয়েকটি ওঁরাও পরিবার মিলে তিন বিঘা জমিতে ওই আমের বাগান করেছেন। তাঁদের একজন মানিক মিনজের স্ত্রী আলোবতি গজার জানান, দলিল জাল করে ওই জমি দখলে নিয়েছিলেন গ্রামের তাইজুদ্দিন ও তাঁর ছেলেরা। এ বিষয়ে তাঁরা উপজেলা ভূমি কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেন। ২০১৭ সালে ওই জমি দখলে নেন চন্দ্র মোহনের ছেলেরা। তাইজুদ্দিন ও তাঁর ছেলেরা ওই জমির ধান পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। পরে তাঁরা আমগাছের চারা লাগান। পাঁচ বছর বয়সী ফলবান গাছগুলোও তাঁরা কেটে দিয়েছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আলোবতি গজার বলেন, ‘হামরা কি এ দ্যাশে থাকতে পারোম না? আগুন দিয়া আদিবাসীর বাড়ি পুড়াইলো। হামাদের গাছ কাটল। হালহাতিয়ার (হাঁসুয়া, লাঠি, কোদাল) লিয়া বাড়ির সামনে দিয়া ঘুরছে আর হুমকি দিছে। বলছে, “দ্যাশে আদিবাসী রাখব না।” হামরা কি এ দ্যাশের নাগরিক না? হামরা কি বিচার পাব না?’
মানিক মিনজ বলেন, ধানের আবাদ ও আম গাছ লাগাতে তাঁদের পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। জমি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। আদালতে রায় তাঁদের পক্ষে গেলে জমি ছেড়ে দেবেন। কিন্তু তাঁরা ফসল নষ্ট ও গাছ কেটে দিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে জানার জন্য তাইজুদ্দিনের বাড়ি গেলেও তাঁর দেখা পাওয়া যায়নি। প্রথমে তাঁর ছেলে পরিচয় দিয়ে একজন বলেন, বাবা বাড়িতে আছেন। বাবাকে ডেকে আনার জন্য তিনি বাড়ির ভেতরে যান। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর তাইজুদ্দিনের মেয়ে পরিচয় দিয়ে এক নারী বলেন, ‘বাবা বাড়িতে নেই, খেতে কাজ করতে গেছে, আসতে দেরি হবে।’
আম গাছ কাটার ঘটনায় ২০ আগস্ট নিয়ামতপুর থানায় লিখিত অভিযোগ করা হয়েছ। গতকাল শনিবার থানার দুজন কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইকরাপাড়ার পাশেই গোমস্তাপুর উপজেলার ধাওয়াকান্দর গ্রামের অবস্থান। গ্রামে ৫১ শতক জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ ছিল। পরে আদালতের রায়ে ওই জমির মালিকানা পান ওঁরাও সম্প্রদায়ের মাবর চাঁন গজার। পরে তিনি জমি বিক্রি করে দেন। সাত মাস আগে সেখানে পাঁচটি ওঁরাও পরিবার বাড়ি নির্মাণ করে। ৫ আগস্ট রাত ১০টার দিকে সেখানে একটি ঘরে আগুন দেওয়া হয়। অন্য চারটি ঘর ভাঙচুর করা হয়।
পোড়া ভিটায় দাঁড়িয়ে কথা সেভেন গজারের স্ত্রী সহজমনি তিগগ্যার সঙ্গে। তিনি বলেন, বাড়িতে দুই ছেলে ও শাশুড়ি ছিলেন। তাঁরা রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। স্বামী (সেভেন গজার) বাড়িতে ছিলেন না; গ্রামের অন্য বাড়িতে টেলিভিশন দেখতে গিয়েছিলেন। ওই সময় (রাত ১০টা) বাড়ির বাইরে মানুষের চলাচলের শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দেখেন বেড়ায় আগুন জ্বলছে। পরিবারে সদস্যদের নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যান। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাড়ির সব কিছু পুড়ে যায়। বাড়ির ভেতর দুই মণ ধান, এক মণ চাল, কালাই–শর্ষে ও টিনের বাক্সে কয়েক হাজার টাকা ছিল। গ্রামের মানুষ আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। তবে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলের বই–খাতাও পুড়ে গেছে। তিনি এখন দুই ছেলে নিয়ে অন্য গ্রামে ভাইয়ের বাড়িতে রয়েছেন। শ্বাশুড়ি তাঁর মেয়ের বাড়ি ও স্বামী গ্রামের একজনের বাড়িতে থাকছেন।
সহজমণি তিগগ্যা আরও বলেন, কবে আবার নিজের বাড়িতে বাস করতে পারবেন, তা বুঝতে পারছেন না। পোড়া ভিটায় আবারও ঘর তুলে বাস করতে ভয় পাচ্ছেন। তাঁদের ধারণা পরিস্থিতির সুযোগে জমি থেকে উচ্ছেদ করতে প্রতিপক্ষের লোকজন এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
কথা হয় প্রতিপক্ষের একজন শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জমি কিনে খারিজ করে খাজনা দিয়ে আসছেন। মাবর চাঁন আদালতে এক তরফা রায় পেয়েছেন। আমরা আদালতে আপিল করেছি। আগুন আমরা লাগাইনি; ভাঙচুর করিনি। তাঁরা নিজেরা এসব করে আমাদের ওপর দায় চাপাচ্ছেন।’