সুনামগঞ্জে ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নামা ঢলে সুরমা নদীর পানি আরও বেড়েছে। রোববার সন্ধ্যা ছয়টায় সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সকাল নয়টায় একই স্থানে পানি বিপৎসীমার আট সেন্টিমিটার নিচে ছিল। ১০ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ১৯ সেন্টিমিটার।
ভারী বৃষ্টির সঙ্গে উজানের পাহাড়ি ঢল নামা অব্যাহত আছে। জেলায় শনিবার সকাল নয়টা থেকে রোববার সকাল নয়টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৩৩২ মিলিমিটার। এটি এ বছরে সুনামগঞ্জে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। অতিবৃষ্টির ফলে সকালে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। রাস্তাঘাটে পানি ওঠায় স্থানীয় লোকজন যাতায়াতের ভোগান্তিতে পড়েন। বিকেলে অবশ্য বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি নেমেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে শুধু সুরমা নদী নয়, সুনামগঞ্জের যাদুকাটা, বৌলাই, রক্তি, কুশিয়ারা, চলতি, পাটলাই, নলজুর, খাসিয়ামারা, কালনীসহ সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। হাওরগুলো এখন পানিতে টইটম্বুর। জেলার সদর, ছাতক, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর ও দোয়ারাবাজার উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পাহাড়ি ঢলে সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন সড়ক প্লাবিত হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা ভোগান্তিতে পড়েছেন। অনেক স্থানে বাঁধের কারণে পানি আটকে থাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। জেলার সদর উপজেলার নেয়ামতপুর থেকে তাহিরপুর উপজেলার আনোয়ারপুর মুখী সড়কের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের হরিপুর এলাকায় একটি সেতুর সংযোগ সড়ক ধসে পড়েছে। এতে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ জানান, এলাকার লোকজন ওই সড়ক দিয়ে চলাচল করেন। সেতুর সংযোগ সড়ক ধসে পড়ায় যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। এ ছাড়া তাঁর এলাকার ১০-১২টি ঘরে পানি প্রবেশ করেছে। একই উপজেলার দক্ষিণ বাদাঘাট ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান এরশাদ মিয়া বলেন, উপজেলার শক্তিয়ারখলা এলাকায় বিশ্বম্ভরপুর-তাহিরপুর সড়ক প্লাবিত হওয়ায় ওই স্থানে লোকজন নৌকায় পারাপার হচ্ছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা বলছেন, ভারী বৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির পূর্বাভাস আছে। সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করলেও বৃষ্টি থামলে পানি কমবে। বড় বন্যার কোনো আশঙ্কা নেই। ছোটখাটো বন্যা হলেও সেটা হবে স্বল্প মেয়াদে।
ভারী বর্ষণে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের কাজীর পয়েন্ট, ষোলঘর, উকিলপাড়া, জামতলা, তেঘরিয়া, উত্তর আরপিননগর, মরাটিলা, হাসননগরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় রোববার জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। কাজীর পয়েন্ট এলাকায় রোববার সকালে হাঁটু সমান পানি ছিল। বিকেলে অবশ্য পানি নেমেছে। শহরের পুরোনো বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাসিন্দা মাহবুবুল হাসান বলেন, বৃষ্টি থামছে না। পানি বাড়ছে। মানুষের মধ্যে গত বছরের বন্যার আতঙ্ক আছে। সেই ভয় এখনো মানুষের মন থেকে যায়নি। এটাই হলো সমস্যা।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত বলেন, ‘আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ভারী বৃষ্টির কারণে শহরের কোথাও কোথাও সামান্য পানি জমেছে। এগুলো দ্রুত নেমে যাবে। আমরা সতর্ক আছি।’
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, ভারী বৃষ্টি হবে। বন্যা হতে পারে। তবে সেটা বড় নয়, ছোট ও স্বল্প মেয়াদে। সুনামগঞ্জে ও উজানে ভারতের মেঘালয়ে একসঙ্গে বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণেই পানি বাড়ছে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী জানান, তাঁরা জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা করেছেন। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি আছে। তিনি বলেন, ‘আমরা সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে রাখছি। পানি বাড়ছে। তবে এখনো জেলার কোথাও বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি।’
সুনামগঞ্জে গত বছর জুন মাসে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছিল। অতিবর্ষণের সঙ্গে উজানের ঢল নেমেছিল কয়েক দিন। শহরে ঢলের পানি ঢোকে গত বছরের ১৬ জুন সকালে। সন্ধ্যা নামার আগেই পুরো শহর প্লাবিত হয়ে যায়। শহরে পানি ছিল চার থেকে ছয় ফুট। বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে সুনামগঞ্জ। বন্ধ হয়ে যায় ইন্টারনেট–সেবা। ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত মাথায় নিয়ে হাজারো মানুষ ছোটেন আশ্রয়ের খোঁজে। উঁচু ভবন, আত্মীয়স্বজনের বাড়িঘর, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেন তাঁরা। সুনামগঞ্জ চার দিন সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। সরকারি হিসাবে জেলার কমবেশি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। মারা যান ১৫ জন। ৫০ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়।