বধ্যভূমির জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে স্থাপনা। সম্প্রতি যশোরের মনিরামপুর উপজেলার কপালিয়া বাজারে
বধ্যভূমির জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে স্থাপনা। সম্প্রতি যশোরের মনিরামপুর উপজেলার কপালিয়া বাজারে

বধ্যভূমিতে স্থাপনা তুলছেন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতা

যশোরের মনিরামপুর উপজেলার কপালিয়া বাজারে বধ্যভূমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। হরি নদের পাড়ের এই বধ্যভূমি দখলের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে উপজেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্যরা।

অভিযুক্ত দুই নেতা হলেন উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল মান্নান সরদার ও ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি এস এম জাহিদুজ্জামান। তাঁদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে বধ্যভূমির জায়গা অরক্ষিত অবস্থায় ছিল। তাঁরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে বধ্যভূমিটি রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছেন।

সম্প্রতি কপালিয়া বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, এক শতকের কম আয়তনের জায়গাটির মাঝখানে বধ্যভূমির স্মৃতিফলক। এর চারপাশে ইট দিয়ে আটটি পিলার নির্মাণ করা হয়েছে। পিলারের সঙ্গে বাঁশ বেঁধে তার ওপর ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। বধ্যভূমির মধ্যে একটি মোটরসাইকেল এবং একটি বাইসাইকেল রাখা হয়েছে। মেঝেতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে ময়লা–আবর্জনা এবং ছেঁড়া নির্বাচনী পোস্টার। পিলার ঘেঁষে রয়েছে একটি ইটের স্তূপ।

যশোরের মনিরামপুর উপজেলার কপালিয়া বাজার বধ্যভূমির স্মৃতিফলক

স্থানীয় বাসিন্দা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে নভেম্বরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজাকারদের সহযোগিতায় কপালিয়া গ্রাম থেকে ১৫ জনকে ধরে নিয়ে আসে। তাঁদের মধ্যে তিনজনকে হরি নদে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। বাকি ১২ জনকে কপালিয়া বাজারে হরি নদের পাড়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। ওই ১২ জনের স্মরণে মনোহরপুর কপালিয়া শহীদ স্মৃতি রক্ষা পরিষদের উদ্যোগে ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ওই স্থানে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। জাতীয় সংসদের তৎকালীন হুইপ শেখ আবদুল ওহাব বধ্যভূমির স্মৃতিফলক উদ্বোধন করেন। রাতে আলোর জন্য পরে স্মৃতিফলকের পেছনে একটি সোলার পোস্ট স্থাপন করা হয়।

শহীদ পরিবারের সদস্যরা বলছেন, এরপর আর বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হয়নি। শহীদদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি আবদুল মান্নান সরদার এবং এস এম জাহিদুজ্জামান বধ্যভূমি দখলে নিয়ে স্মৃতিফলক মাঝখানে রেখে ঘর নির্মাণ করছেন। তাঁরা সোলার লাইটপোস্টটি তুলে বধ্যভূমির বাইরে এনে স্থাপন করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কপালিয়ায় ১৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সেখানে একটি বদ্ধভূমি আছে। তাঁদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়া দুঃখজনক।
গাজী আবদুল হামিদ, সাবেক ডেপুটি কমান্ডার, মনিরামপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ

বধ্যভূমি দখলের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএও) কাছে অভিযোগকারীদের একজন শামছুর মোল্যা। তিনি বলেন, ‘হরি নদের খেয়াঘাটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে নিহত ১২ জনের মধ্যে আমার তিন চাচাতো ভাই রয়েছেন। দেশ স্বাধীনের ৫২ বছর পার হলেও তাঁরা স্বীকৃতি পাননি। সাবেক হুইপ শেখ আবদুল ওহাব কপালিয়া বাজারে শহীদদের স্মরণে বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেছিলেন। সেটাও আর থাকছে না।’

আরেক অভিযোগকারী মশিয়ার রহমান সরদার বলেন, ‘নিহত শহীদদের মধ্যে আমার এক আপন ভাই, এক চাচাতো ভাই এবং এক চাচা রয়েছেন। তাঁরা স্বীকৃতি পাননি। তাঁরা যেখানে শহীদ হয়েছিলেন, সেই বধ্যভূমিও দখল হয়ে গেল।’

মনিরামপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার গাজী আবদুল হামিদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় কপালিয়ায় ১৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সেখানে একটি বদ্ধভূমি আছে। তাঁদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়া দুঃখজনক।

অভিযোগের বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মান্নান সরদার বলেন, ‘বধ্যভূমি অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন ছিল। মানুষ সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করত। আমরা সেটা পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করে সুন্দরভাবে রেখে দিয়েছি। ওই জায়গায় কোনো দোকানঘর নির্মাণ করা হবে না। এলাকার কিছু মানুষ আমাদের বিরুদ্ধে এসব ছড়াচ্ছে।’ একই সুরে যুবলীগ নেতা এস এম জাহিদুজ্জামান বলেন, ‘সেখানে কেউ যাতে কিছু না রাখতে পারে, সে জন্য ইটের পিলার তুলে দিয়েছি। বধ্যভূমিকে সুন্দর করে রাখা হয়েছে। ওইখানে কোনো দোকানঘর হবে না, ঘর ভাড়াও দেওয়া হবে না।’

জানতে চাইলে ইউএনও জাকির হোসেন বলেন, ‘এ ব্যাপারে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। এ বিষয়ে যাচাই–বাছাই করা হচ্ছে। যাচাই–বাছাইয়ে ওই জায়গায় বধ্যভূমি থাকলে প্রয়োজনীয় সংরক্ষণের জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে লিখব। কিন্তু জমিটি খাস হলে এবং বধ্যভূমি না থাকলে আইন অনুযায়ী সেখান থেকে অবকাঠামো উচ্ছেদ করা হবে।’

মনিরামপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. আলাউদ্দিন বলেন, উপজেলায় এখন পর্যন্ত যেসব বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়েছে, তার মধ্যে কপালিয়া নেই। তবে চিহ্নিত হয়নি বলে সেখানে বধ্যভূমি নেই, এটা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধকালীন কপালিয়ায় ১৫ মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।