নদীয়ায় মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রসনা তৃপ্ত করতেই নাকি শিঙাড়ার উদ্ভব। একদা তার সভায় ‘সমভূজা’ নামের এক খাদ্যবস্তু তৈরি হয়েছিল বলে শোনা যায়। সেই সমভূজা থেকে সমুচা বা শিঙাড়া নামের উৎপত্তি বলে অনেক খাদ্য ঐতিহাসিকের মত।
যেভাবেই শিঙাড়া আসুক, এখন একে আর অস্বীকার করার উপায় নেই। অতিরিক্ত ওজনের ভয় বা শরীরের ক্ষতি স্বীকার করে খাব না, খাব না বলেও সবাই শিঙাড়া খান। কিন্তু শিঙাড়া খাওয়ার আসল সময় কখন? এ নিয়ে রয়েছে নানা রকম মত। কেউ বলেন বিকেলের নাশতায়, কেউবা মনে করেন সকালে। তবে অধিকাংশ মতামত বলছে, সকালের নাশতা আর দুপুরের খাবারের মধ্যবর্তী সময়েই শিঙাড়ার উত্তপ্ত অবস্থান। সে হিসাবে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা—এই সময়কে শিঙাড়ার লগ্ন বললেও ভুল হবে না। চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন দোকান ঘুরেও তার প্রমাণ পাওয়া গেল। সকালের নাশতা শেষ হওয়ার পরই শুরু হয় শিঙাড়ার বিক্রি।
চট্টগ্রাম নগরে এক সময় ভালো শিঙাড়া তৈরি হতো বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁয়। বোস ব্রাদার্স, জামান, গ্র্যান্ড হোটেল, নোবেলটি, ফ্রেসো হোটেলের কথা জানেন ৮০ ও ৯০ দশকে বেড়ে ওঠা নাগরিকেরা। ভালো শিঙাড়া আর চায়ের জন্য এসব রেস্তোরাঁর সুনাম ছড়িয়েছিল। এখন অবশ্য সেই দিন আর নেই।
নগরে ভালো শিঙাড়ার কদর থাকলেও সেই রমরমা দিন আর নেই। তবু গরম-গরম আলু, কলিজার খেতে দূরদূরান্ত থেকে ভোজনরসিকেরা ছুটে আসেন চট্টগ্রামের আলকরণ মোড়ের মালঞ্চ কিংবা জিইসির মোড়ের ক্যান্ডিতে। চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড়ের মোড়কে তো শিঙাড়ার গলিই বলা যায়। এখানে আছে পাঁচ থেকে ছয়টি দোকান, যার প্রতিটিতেই সকাল-বিকেল গরম তেলে শিঙাড়া ভাজা হয়। এ ছাড়া নগরের হাজারি গলি ও তিন পোলের মাথায় কাচের বাক্সে বিক্রি হয় ছোট শিঙাড়া। এই শিঙাড়ার সুখ্যাতি রয়েছে পুরোনো বাসিন্দাদের মধ্যে।
অভিজ্ঞজনেরা বলেন, ভালো শিঙাড়া প্রতি কামড়ে এক অন্য রকম বিস্ময় এনে দেবে। শহরের পুরোনো আড্ডারু কবি ও সাংবাদিক ওমর কায়সারের মতে, ভালো শিঙাড়ার আবরণ হবে পাতলা মুচমুচে। ভেতরের পুরে থাকবে সুন্দর করে কাটা আলু, নারকেল, মটর, ধনেপাতা, ফুলকপি আর নানা মসলা।
শিঙাড়া নিয়ে ওমর কায়সার এখন কিছুটা হতাশ। তিনি বলেন, এক সময় শিঙাড়া খাওয়া হতো আয়োজন করে। সর্ষে বাটা, পেঁয়াজ আর শসার টুকরার সঙ্গে শিঙাড়া সাজিয়ে পরিবেশন করা হতো। এখন এসব উঠে গেছে। শিঙাড়া বিলাসিতা এখন আর নেই।
চট্টগ্রামের শিঙাড়া নিয়ে আক্ষেপ কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেনেরও। তাঁর মতে, যে শহরে ভালো শিঙাড়া হয় না, সে শহরে ভালো সাহিত্য-সংস্কৃতিও হয় না। সাহিত্যের আড্ডা জমাতে হলে ভালো শিঙাড়া লাগবে। চট্টগ্রামে শিঙাড়ায় ঠিক সেই তৃপ্তিটা আসে না। কোথাও আকার ঠিক হচ্ছে না, কোথাও বা পুরটা মজা হচ্ছে না। শিঙাড়ার ওপরের আবরণটাও মুচমুচে হয় না, নরম হয়ে থাকে। বরং শহর থেকে বের হলে মফস্সল এলাকায় অনেক উৎকৃষ্ট মানের শিঙাড়া পাওয়া যায়।
তবে ভালো শিঙাড়া বলতে আসলে কি বোঝায়, এ বিষয়ে নানা মত থাকলেও অভিজ্ঞ রাঁধুনি ও রান্নাবিষয়ক লেখিকা জোবায়দা আশরাফের মতে, আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারি। ভালো শিঙাড়া অবশ্যই দেখতে নিখুঁত হতে হবে। অর্থাৎ এর তিন কোনা আকার হবে সুষম।
জোবায়দা আশরাফ প্রথম আলোকে বলেন, ভালো শিঙাড়া তৈরি রীতিমতো একটা শিল্প। এর আকার ও ঘ্রাণ প্রথমেই আকর্ষণ করতে হবে। এ ছাড়া শিঙাড়ার মূল জিনিসটাই হচ্ছে এর জিরা দিয়ে তৈরি বিশেষ মসলা। এ ছাড়া শিঙাড়ার প্রতি কামড়ে আলু আর পেঁয়াজের স্বাদ মুখ ভরিয়ে দেবে। পেঁয়াজ যাতে একেবারে বেশি রান্না না হয়ে যায়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আলু তো বটেই, মাংস, কিমা, কলিজা, বাদাম, পনির এমনকি শীতের সবজিও বাদ যায় না শিঙাড়ার পুর থেকে।
খাবার হিসেবে শিঙাড়াকে অস্বাস্থ্যকর বলেন চিকিৎসকেরা। তবে তাঁদের নিষেধ অমান্য করা মানুষই দলে ভারী। দিন দিনই এই খাবার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বিশ্বজুড়ে। শুনলে অবাক হবেন, কেবল শিঙাড়ার জন্যই বরাদ্দ রাখা রাখা হয়েছে গোটা একটা দিন। প্রত্যেক বছর ৫ সেপ্টেম্বর পালিত হয় বিশ্ব শিঙাড়া বা সমুচা দিবস।