আগে গোপালপুরে স্বামীর বাড়িতেই পারুল ‘কলাচিকিৎসা’ করতেন। প্রশাসন বাগড়া দেওয়ায় তিন বছর ধরে তিনি বাবার বাড়িতে এ কাজ করছেন।
একটা কলা চার টুকরা করে চারজনকে খাওয়ানো হচ্ছে। এক টুকরার দাম ৩০ টাকা। গত বছর এক টুকরার দাম ছিল ২০ টাকা। এবার সবকিছুর দাম বেড়েছে, তাই কলার দামও বাড়ানো হয়েছে। শ্বাসকষ্ট থেকে মুক্তির আশায় এই কলা খেতে অন্তত চারটি জেলার কয়েক শ মানুষ ভিড় করেন কবিরাজের বাড়িতে।
২৪ অক্টোবর সারা দিন বৃষ্টি ছিল। এরই মধ্যে মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত রিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহন নিয়ে এসেছেন নাটোরের লালপুর উপজেলার কলসনগর গ্রামে। এই লালপুর উপজেলারই একটি গ্রামে ‘হাড়ভাঙা চিকিৎসকের হাট’ গড়ে উঠেছিল। এখন কলসনগর গ্রামে পারুল (৬০) নামের এক নারী বছরের এক দিন কলার সঙ্গে ‘গাছগাছড়া’ দিয়ে কথিত চিকিৎসা করেন। তাঁর বাবার নাম সবিউল্লাহ। পারুলের স্বামীর নাম আবু বকর। তাঁর বাড়ি লালপুর উপজেলার গোপালপুর গ্রামে।
স্থানীয় লোকজন জানান, কয়েক বছর আগে গোপালপুরে স্বামীর বাড়িতেই পারুল ‘কলাচিকিৎসা’ করতেন। কিন্তু প্রশাসন বাগড়া দেওয়ার কারণে তিন বছর ধরে তিনি বাবার বাড়ি কলসনগরে ‘কলাচিকিৎসা’ দিচ্ছেন। এ ছাড়া উপজেলার গোপালপুর বাজার এলাকায় মাইকেল নামের এক ব্যক্তি একই ‘চিকিৎসা’ দেন।
লালপুর উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে ‘হাড়ভাঙা চিকিৎসকের হাট’ বসত। ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘গ্রামটি এখন হাড়ভাঙা চিকিৎসার হাট’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর আগে ২০১০ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘কবিরাজের বাড়িতে ২০ শয্যার হাসপাতাল’ শিরোনামে প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালিয়ে কবিরাজদের উচ্ছেদ করা হয়।
১০ বছর পর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের বাড়ি বাড়ি কবিরাজবাড়ির সাইনবোর্ড ঝুলছে। গ্রামের যাঁরা দিনমজুরি করতেন, তাঁরাও এই ‘চিকিৎসাবিদ্যা’ রপ্ত করে গ্রামে ও গ্রামের বাইরে গিয়ে রোগী দেখেন।
কলাচিকিৎসার ব্যাপারে লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনোয়ারুজ্জামান বলেন, তিনি খবরটি শুনে প্রশাসনকে জানিয়েছেন। কেউ অভিযোগ করলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।
যাঁরা কলা খাচ্ছেন, তাঁরা বলছেন, কবিরাজ পারুল তাঁর নিয়ম অনুযায়ী এই অমাবস্যার (কালীপূজার দিন) সন্ধ্যা থেকে পরের দিন সকাল ১০টা পর্যন্ত রোগীদের এই কলাচিকিৎসা দিয়ে থাকেন। সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার জন্য তাঁর কাছে তিন বছর এই কলাচিকিৎসা নিতে হয়।
২৪ অক্টোবর বিকেলে কলসনগর গ্রামে ঢুকতে গিয়ে দেখা যায়, দূর থেকে রাস্তার ধারে মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও রিকশা রাস্তার দুই ধারে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে। রাস্তায় ছাতামাথায় মানুষের ভিড়। এরই মধ্যে দিয়ে নতুন রোগী নিয়ে যানবাহন ঢুকছে, কলা খাওয়া রোগীদের নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। পারুলের বাবার বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায়, ভিড় সামাল দিতে বাঁশ দিয়ে বুথ করে দেওয়া হয়েছে। এর ভেতরে দিয়েই সারি সারি মানুষ ঢুকছেন। বুথের মুখে জানালা দিয়ে টাকা নিয়ে রোগীর মুখে কলা তুলে দেওয়া হচ্ছে। রাস্তার দুই ধারে পলিথিন টাঙিয়ে বসেছে অস্থায়ী দোকান। কেউ কেউ শুধু কলাই বিক্রি করতে এসেছেন। কিছু মানুষ স্বেচ্ছাসেবকের মতো কাজ করছেন। কলাচিকিৎসার উপকারের কথা জানতে চাইলে তাঁরা যেন মুখস্থ বলে দিচ্ছেন, উপকার না হলে এত দূর থেকে মানুষ কেন আসবে? অবশ্যই উপকার পাচ্ছে।
তদারক করছেন পারুলের ছয় ভাই। এক ভাই নিজেকে এই আয়োজনের কর্ণধার দাবি করে ছবি না তোলার জন্য অনুরোধ করেন। নাম জানতে চাইলে বললেন, ‘ভাই, নামটা না বলি।’ পারুলের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অসম্ভব! অবশেষে মানুষের ভিড়ের ছবি তুলতে গেলে তিনি বলেন, ‘আমরা এই টাকা এলাকার মসজিদে দান করি। আমারে কোনো স্বার্থ নেই। আগামীবার থাইকি এমনি বন্ধ কইর দিব। ছবি তুলবেন না।’
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থেকে এক মাইক্রোবাসে ১৩ জন এসেছেন। তাঁদের একজন আনারুল বলেন, গতবার খেয়ে একটু আরাম পেয়েছেন। তাই আবার এসেছেন। লালপুরের ঘাটচিলান গ্রামের গৌরচন্দ্র (৫৬) কলা খেয়ে বলেন, ‘একটা “জিনকলা” চার ভাগ করে এক ভাগ একজনের মুখে দেওয়া হচ্ছে। এর ভেতরে “গাছ” দেওয়া হইচে। এই জিনকলা, হাঁসের মাংস আর হাঁসের ডিম সারা জীবনে আর খাওয়া যাবি না।’
এক প্রতিবেশী বলেন, স্থানীয় ইউপি সদস্য আবু সাঈদ সরকারের মাধ্যমে থানার ওসিকে টাকা দিয়ে এ কাজ চলছে। জানতে চাইলে আবু সাঈদ সরকার বলেন, মানুষ বিশ্বাস নিয়ে আসে। তাই তিনি থানায় গিয়েছিলেন। টাকা নেওয়ার অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন।
গত মঙ্গলবার সকালে লালপুর উপজেলা পরিষদের গেটের সামনে পারুলের স্বামী আবু বকরকে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ২০০৫ সাল থেকে তাঁর স্ত্রী এই চিকিৎসা দেন। মানুষ ছাড়ে না, তাই বাধ্য হয়ে এই চিকিৎসা দেন।