দিনাজপুরের ঐতিহাসিক গোর-এ-শহীদ ঈদগাহ ময়দানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঈদের নামাজ পড়তে আসেন লাখ লাখ মানুষ। ঈদের জামাতকে ঘিরে এখানে সৌহার্দ্যের পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
এখানে নামাজ পড়লে বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে-এ ধারণা থেকে অনেকেই দূরদূরান্ত থেকে থেকে এখানে আসেন। তাই তাঁদের জন্য বিশেষ ট্রেন সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যথাযথভাবে ঈদের জামাত আয়োজনের প্রস্তুতিও নিয়েছে প্রশাসন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে এই ঈদগাহে মিনার তৈরির পর দেশের তথা এশিয়ার বৃহত্তম ঈদগাহ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ বড় ময়দান।
গোর-এ-শহীদ বড় ময়দানে ঈদগাহ মিনার নির্মাণের পর কয়েকবার ঈদের জামাতে অংশ নিয়েছেন চিরিরবন্দর উপজেলার ইমরান আলী (৪২)। মুঠোফোনে তিনি জানান, এই ঈদগাহে একসঙ্গে লাখ লাখ মানুষ নামাজ আদায় করেন। এতে একদিকে যেমন সওয়াব পাওয়া যায়, তেমনি অনেকের সঙ্গে দেখা হয়।
গোর-এ-শহীদ ঈদগাহ ময়দানের আয়তন ২২ একর। ঈদগাহ ময়দানের পশ্চিমে লাল খয়েরি আর সাদা রঙের মিশ্রণে নির্মিত মিনারটির সৌন্দর্য সহজেই সবার নজর কাড়ে। মিনার নির্মাণের প্রথম বছরেই ছয় লক্ষাধিক মুসল্লির ঈদুল ফিতরের নামাজে উপস্থিতি মাঠের গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলেছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, এবারও সর্বোচ্চসংখ্যক মুসল্লির নামাজ আদায়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ঈদের দিন সকাল নয়টায় জামাত অনুষ্ঠিত হবে। মাওলানা শামসুল ইসলাম কাসেমীর ঈদ জামাতের ইমামের দায়িত্ব পালন করার কথা রয়েছে।
গোর-এ-শহীদ ঈদগাহ ময়দানের নাম নিয়ে একাধিক মত প্রচলিত আছে। জেলার কয়েকটি ইতিহাসগ্রন্থ থেকে জানা যায়, এ মাঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর উত্তর ফ্রন্টের সমাবেশ হয়েছিল। পরে মাঠটি সেনাবাহিনীর নামে রেকর্ডভুক্ত হয়।
এই ঈদগাহ ময়দানের নামকরণ নিয়ে আরও কিছু জনশ্রুতি রয়েছে। স্থানীয় কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পারস্য থেকে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে এসে মৃত্যুবরণ করেন শাহ আমিরউদ্দিন ঘুরি (রহ.)। পরে মাঠসংলগ্ন স্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। আমিরউদ্দিন ঘুরি ঘোড়ায় চড়ে দিনাজপুরে ইসলাম প্রচার করেন। সে জন্য এ মাঠের নামকরণ করা হয়েছে গোর-এ-শহীদ।
আরেকটি জনশ্রুতি হলো, সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের আমলে ইসলাম প্রচার নিয়ে ৪০ জন সুফির সঙ্গে ওই সময়ের এক হিন্দু রাজার যুদ্ধ হয়েছিল। সুফিদের একজন প্রাণ হারান। সেখানেই তাঁকে কবর দেওয়া হয়। আরবি শব্দ কবরকে ফারসিতে গোর বলা হয়। ওই সময়কার মুসলিম শাসকের ভাষা ফারসি হওয়ায় মাঠটি পরিচিতি পায় গোর-এ-শহীদ ময়দান হিসেবে।
গত শনিবার সকালে মাঠ ঘুরে দেখা যায়, দেড় শতাধিক শ্রমিক মিনার ধোয়ামোছা ও মাঠ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন। ঈদগাহ প্রস্তুত কমিটির আহ্বায়ক পৌর কাউন্সিলর সানোয়ার হোসেন বলেন, সপ্তাহ দুয়েক আগে মাঠের গর্ত ভরাট করা হয়েছে। বর্তমানে রোলার দিয়ে মাঠ সমান করে চুন দিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে লাইন টানার কাজ চলছে। মাঠের চারপাশে ১৭টি প্রবেশপথ, চারটি ওয়াচ টাওয়ার ও গাড়ি পার্কিংয়ের কাজ চলছে। মিনারের পেছনে অজুখানা পূর্ব দক্ষিণ কোনো টয়লেট পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন কয়েকজন শ্রমিক।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে ছোট পরিসরে এখানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ২০১৫ সালে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইকবালুর রহিম মাঠে ঈদগাহ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। ঈদগাহ মিনারটি নির্মাণ করা হয়েছে মোগল স্থাপত্যরীতিতে। ৫২ গম্বুজবিশিষ্ট ঈদগাহ মিনারের দুই প্রান্তে দুটি মিনারের উচ্চতা ৬০ ফুট। মাঝের দুটির উচ্চতা ৫০ ফুট। টাইলস করা মেহেরাবের উচ্চতা ৪৭ ফুট। এতে খিলান আছে ৩২টি। প্রতিটি গম্বুজে আছে বৈদ্যুতিক বাতি।
ঈদের জামাত আয়োজন প্রশাসন থেকে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(সার্বিক) দেবাশীষ চৌধুরী বলেন, দেশের বৃহত্তম ঈদগাহ মাঠে নামাজ আদায়ে প্রচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিনিধিদের নিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাশের জেলা-উপজেলা থেকে আসা মুসল্লিদের জন্য বিশেষ ট্রেন সার্ভিসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে দুটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
দিনাজপুর রেলস্টেশন সুপারিনটেনডেন্ট জিয়াউর রহমান বলেন, ঈদের দিন সকাল ছয়টায় পার্বতীপুর রেলস্টেশন থেকে একটি এবং ঠাকুরগাঁও রেলস্টেশন থেকে ভোর পাঁচটায় একটি বিশেষ ট্রেন ছাড়বে দিনাজপুরের উদ্দেশে। ঈদের নামাজ শেষে সকাল সাড়ে নয়টায় ট্রেন দুটি ফেরত যাবে। পথে প্রতিটি স্টেশনে দাঁড়াবে ট্রেন দুটি।
ঈদের জামাত যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এই বিষয়ে দিনাজপুর পুলিশ সুপার শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে নামাজ আদায়ের জন্য সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঈদগাহ মাঠজুড়ে থাকবে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা। ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা স্থাপনের পাশাপাশি থাকবে গোয়েন্দা নজরদারি। মাঠের আশপাশে পুলিশ র্যাব, বিজিবি, আনসার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করবেন।