সবুজ-শ্যামল ছায়াঘেরা আশ্রয়কেন্দ্রটির চারপাশেই হাঁটুপানি। ভেতরে ঢোকার রাস্তায় পানির গভীরতা প্রায় কোমর ছুঁয়েছে। আশ্রয় নেওয়া বন্যাদুর্গত মানুষের যাতায়াত কিংবা প্রয়োজনীয় সামগ্রী আনা–নেওয়ার সুবিধার্থে রাখা হয়েছে বড় একটি নৌকা। দিনরাত এতে অবস্থান করেন কয়েকজন কিশোর-তরুণ স্বেচ্ছাসেবক। তাঁরা আশ্রয়কেন্দ্রটির বাইরে আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
দুই বেলা খাবার থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায়, নিয়মিত চিকিৎসাসেবা এমনকি নারীদের মাসিককালীন সময়ে স্যানিটারি ন্যাপকিনও সরবরাহ করা হচ্ছে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রটিতে। বন্যাকবলিত বিভিন্ন অঞ্চলের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে যখন নানামুখী সংকটের কথা শোনা যাচ্ছিল, তখন এমন এক ব্যতিক্রমী আশ্রয়কেন্দ্রের দেখা মেলে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নে। স্থানীয় গাবুয়া এলাকায় টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে বানানো হয়েছে এটি। জেলার চৌমুহনী মাইজদীপ মহাসড়কের পূর্ব পাশে সড়ক থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে এর অবস্থান।
গতকাল সোমবার বিকেলে জেলা শহর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের ওই আশ্রয়কেন্দ্রে সরেজমিনে এসব দৃশ্য দেখা গেছে। দ্বিতল ভবনের ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই দেখা যায়, বাইরে অনেক জোড়া জুতো। আর ভেতরের মেঝে পরিষ্কার-ঝকঝকে। সবাই জুতো বাইরে রেখে সেখানে অবস্থান করছেন। কেউ এসেছেন শুনে এগিয়ে এলেন ইনস্টিটিউটের সুপারিনটেনডেন্ট। তাঁর কার্যালয় কক্ষে ডেকে নেন এই প্রতিবেদককে। হালকা আলাপচারিতার মধ্যে সেখানে হাজির হন নোয়াখালীর ২৫০ বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক নাহিদ হাসান। আশ্রয় নেওয়া অসুস্থ শিশুসহ বন্যার্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে তিনি সেখানে এসেছেন। প্রতিটি কক্ষ ঘুরে ঘুরে অসুস্থ ব্যক্তিদের সেবা দিতে দেখা যায় তাঁকে।
কেন্দ্রটিতে আশ্রয় নেওয়া সৌদিপ্রবাসী তাজুল ইসলাম (৩২) প্রথম আলোকে জানালেন, অনন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা তিনি। বাড়িতে কোমরসমান পানি। আর ঘরের ভেতর পানির গভীরতা হাঁটুসমান। সাত দিন আগে স্ত্রী, সন্তান, মাসহ পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে উঠেছেন এই আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানে তাঁরা ভালো আছেন, তবে বন্যার বীভৎসতা তাড়িয়ে বেড়ায় সারাক্ষণ। এর আগে তাঁরা এমন বন্যা দেখেননি।
এ কেন্দ্রের মোট ছয়টি কক্ষে আশ্রয় নিয়েছেন বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের অনন্তপুর, কামদেবপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের ৩০টি পরিবারের অন্তত ১৫০ জন সদস্য। পরিচ্ছন্ন কক্ষগুলোতে প্রতিটি পরিবারকে বেঞ্চ দিয়ে আলাদা আলাদা জায়গা (নির্দিষ্ট সীমানা) করে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা নিজেদের মতো থাকছেন আপন বাড়িঘরের মতোই। সেখানে নারী-শিশু ও বয়োবৃদ্ধ মানুষ যেমন আছেন, তেমনি আছেন গর্ভবতী নারীরাও। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু আছে ১৫ জন। তাদের খাবারদাবারে যাতে কোনো ধরনের অযত্ন না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর আছে কর্তৃপক্ষের।
তিন বছর বয়সী অসুস্থ শিশু ছেলে আবদুর রহমানকে নিয়ে এক সপ্তাহ আগে ওই আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন কামদেবপুর গ্রামের বাসিন্দা প্রীতি আক্তার (৩২)। তিনি বলেন, তাঁদের ঘরে হাঁটুসমান পানি। সেখানে যাওয়ার পর আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো আছেন। চিকিৎসার পর ছেলেটার অসুস্থতাও (জ্বর) কিছুটা কমেছে। তাঁর মতে, সেখানে থাকা–খাওয়ারসহ যেসব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, তা বাড়ির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়; বরং ক্ষেত্রবিশেষে অনেক বেশি।
এক বছর বয়সী ছেলে ইমাম হোসেন কয়েক দিন ধরে পাতলা পায়খানা ও জ্বরে ভুগছে। চিকিৎসক নাহিদ হাসান শিশুটিকে পরীক্ষা করে দেখলেন। মা ফারিয়া আক্তার প্রিয়ার (২৫) সঙ্গে কথা বলে লিখে দিলেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপত্র; দিলেন কিছু পরামর্শও। সেখানে আশ্রয় নেওয়া প্রতিটি শিশুর মায়ের কাছে গিয়ে তিনি জানতে চাইলেন, কারও কোনো অসুস্থতা আছে কি না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যবস্থাপত্র দিলেন এবং ব্যক্তিগত তহবিল থেকে কিছু ওষুধের ব্যবস্থাও করে দিতে দেখা যায় এই তরুণ চিকিৎসককে।
চিকিৎসক নাহিদ হাসান যখন শিশুদের দেখছিলেন, তখন পাশ থেকে মো. রিফাত নামের এক তরুণ এগিয়ে এলেন। তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী সানজিদা আক্তারের (১৮) কিছু শারীরিক সমস্যার কথা জানাচ্ছিলেন। চিকিৎসক ওই গর্ভবতীকেও কিছু পরামর্শ দিলেন এবং সেগুলো মেনে চলার গুরুত্ব বুঝিয়ে বললেন। এ সময় আশ্রিত মানুষদের দেখতে আসেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার আবু সায়েম। তিনি অসুস্থ নারী ও শিশুদের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরও ওষুধ কিনে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
কেন্দ্রটিতে আশ্রয় নেওয়া সৌদিপ্রবাসী তাজুল ইসলাম (৩২) প্রথম আলোকে জানালেন, অনন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা তিনি। বাড়িতে কোমরসমান পানি। আর ঘরের ভেতর পানির গভীরতা হাঁটুসমান। সাত দিন আগে স্ত্রী, সন্তান, মাসহ পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে উঠেছেন এই আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানে তাঁরা ভালো আছেন, তবে বন্যার বীভৎসতা তাড়িয়ে বেড়ায় সারাক্ষণ। এর আগে তাঁরা এমন বন্যা দেখেননি।
সেখানে সার্বক্ষণিক স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে আছেন ইনস্টিটিউটটির পাঁচ শিক্ষার্থী। তাঁরা পালা করে মানুষের খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি জরুরি প্রয়োজনে নৌকায় করে তাঁদের কেন্দ্রের বাইরে আনা–নেওয়া করেন। তাঁদের একজন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী দিদার হোসেন মোহন। সে জানায়, বন্যার্ত মানুষের সেবা করতে পেরে তাঁর কাছে খুব ভালো লাগছে। কোনো ক্লান্তি লাগে না। বাড়িতে মা-বাবাও তাঁর এই সেবামূলক কাজের কথা শুনে খুশি। আরেক শিক্ষার্থী মো. রিফাত জানায়, সে দশম শ্রেণিতে পড়ছে। নিজের প্রতিষ্ঠানে বন্যার্ত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন জানার পরই ছুটে এসেছে তাঁদের সেবা করতে।
সন্ধ্যায় আশ্রয়কেন্দ্রটিতে নৌকা নিয়ে প্রবেশ করছিলেন দুই স্বেচ্ছাসেবক। সেনিটারি ন্যাপকিনের বড় দুটো কার্টুন নিয়ে এসেছেন তাঁরা। সুপারিনটেনডেন্ট মো. মোজাম্মেল হক জানালেন, আশ্রয় নেওয়া নারীদের প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে এসব সেনিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
শুরুর দিকে বন্যার্ত মানুষের আশ্রয়হীন হয়ে পড়ার বিষয়টি বেশ পীড়া দিয়েছিল মোজাম্মেল হককে। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনুমতি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির দরজা খুলে দিয়েছেন বন্যাক্রান্ত মানুষের জন্য। মুহূর্তের মধ্যেই আশ্রয়প্রার্থীরা আসতে শুরু করেন। প্রথম দিনই আশ্রয় নেন ৮০ জন। এতগুলো লোক হঠাৎ একসঙ্গে এসে পড়ায় অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন, কীভাবে পরিস্থিতি সামলাবেন, তা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েন।
মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, পরে বিষয়টি নিয়ে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেন তিনি। কিছু না ভেবেই মুহূর্তেই তাঁর স্ত্রী জবাব দেন, তিনি বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য খাবার রান্না করে দিতে চান। এভাবে পরপর তিন দিন তাঁর স্ত্রী নিজের বাসা থেকে খাবার রান্না করে দেন। পরে অবশ্য ইনস্টিটিউটের ভেতরেই রান্নার ব্যবস্থা হয়েছে। আশ্রয় নেওয়া নারীদের কয়েকজন সেখানে রান্না করেন। আর রান্নার সব বন্দোবস্ত করে দেন মোজাম্মেল হক। এ উদ্যোগে তাঁকে সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন নিজের বন্ধু এবং পরিচিতজনেরা।
বন্যার্ত মানুষ আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে নিয়মিত সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাঁর কার্যালয়ে বসে সবকিছু তদারকি করেন মোজাম্মেল হক। তিনি চান দুর্যোগ কেটে গিয়ে শিগগিরই স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরুক বন্যাদুর্গত মানুষেরা।