ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পদে উপনির্বাচন। বাড়ি থেকে ৫০০ গজ দূরে ভোটকেন্দ্র। ফলাফল জানতে মা সালমা বেগমকে বলে কেন্দ্রে যান হৃদয় ভূঁইয়া (২৩)। মা-ও নিষেধ করেননি। ভোটকেন্দ্রের সামনে সংঘর্ষে ছেলের মৃত্যুর পর সালমা বেগমকে সেই আক্ষেপই পুড়িয়ে মারছে। বারবার আক্ষেপ করছিলেন, কেন ছেলেকে আগলে রাখলেন না। বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, ‘এইডা কেমন রাজনীতি? এই রাজনীতি মানুষ মারার রাজনীতি। এই রাজনীতি আমার বুকের ধনরে কেড়ে নিল।’
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য পদে উপনির্বাচনে ফলাফল ঘোষণা নিয়ে সংঘর্ষে হৃদয় নিহত হন। ফলাফল ঘোষণার পর গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় তালা প্রতীকের প্রার্থী কায়সার আহম্মেদ ওরফে রাজুর সমর্থকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। পরে মোরগ প্রতীকের প্রার্থী আবদুল আজিজ সরকারের সমর্থকেরাও সংঘর্ষে জড়ান। নিহত হৃদয় ভূঁইয়া দুধঘাটা গ্রামের আমির আলী ভূঁইয়ার ছেলে।
আজ রোববার সকালে দুধঘাটা বাজারে যেতেই পুলিশের সরব উপস্থিতি দেখা যায়। সড়কজুড়ে দুই প্রার্থীর পোস্টারের ছড়াছড়ি। বাজার থেকে দক্ষিণে এগিয়ে গেলে হৃদয়দের বাড়ি। আর হৃদয়দের বাড়ির ৫০০ গজ পূর্বে আবদুল আজিজের বসতি। তাঁর বাড়ির সীমানা ঘেঁষেই দুধঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওই কেন্দ্রের সামনেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
সকালে হৃদয়দের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, প্রতিবেশী ও স্বজনেরা ভিড় করছেন। ভাইয়ের শোকে বিছানায় গড়াগড়ি করে বিলাপ করছেন হৃদয়ের ছোট বোন। পাশেই আহাজারি করছেন মা সালমা বেগম। ছেলের মৃত্যুর পর থেকে তিনি পাগলপ্রায়। ছেলের শোকে বাক্রুদ্ধ হয়ে গেছেন হৃদয়ের বাবা।
হৃদয়ের বড় ভাই রিটন ভূঁইয়া জানান, তাঁরা তিন ভাই ও এক বোন। ভাইদের মধ্যে হৃদয় ছোট। গতকাল হৃদয়ের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। রাতভর আহাজারি করেছেন। সকালেও বিলাপ থামেনি। তিনি বলেন, স্থানীয় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইলেকট্রনিক মিস্ত্রির কাজ করতেন হৃদয়। ভোটের কারণে গতকাল তিনি কাজে যাননি। সকালে ভোট দিয়ে এসে ঘুমিয়ে ছিলেন। বিকেলে ফলাফল জানতে বাড়ির পাশে কেন্দ্রে যান। তখনই সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আজ ময়নাতদন্তের পর পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে।
দুপুরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে মাটিতে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখা গেল। সেখানে কথা বলতে স্থানীয় কাউকে পাওয়া যায়নি। বিদ্যালয়ের ভেতর ঢুকে শিক্ষার্থীদের পাওয়া গেল না। শ্রেণিকক্ষগুলো তালাবদ্ধ। তিনজন শিক্ষক কার্যালয়ে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নূর সালমা প্রথম আলোকে বলেন, গতকালের সংঘর্ষের পর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা আতঙ্কিত। আজ সকালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী এসেছিল। শিক্ষার্থী না থাকলেও তাঁরা বিদ্যালয় খোলা রেখে বসে আছেন।
বিদ্যালয়ের পাশে আবদুল আজিজ সরকারের বাড়িতে গিয়ে পুরুষ কাউকে পাওয়া যায়নি। কয়েকজন নারী একসঙ্গে বসে আলাপ করছেন। আবদুল আজিজের ভাবি নূর জাহান বলেন, গতকালের ঘটনায় তাঁর দেবরসহ পরিবারের লোকজনকে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু এ ঘটনায় তাঁর পরিবারের কেউ জড়িত নন। তবুও পুলিশ ও নিহতর স্বজনদের ভয়ে তাঁদের বাড়ির পুরুষেরা এলাকা ছেড়েছেন। তিনি বলেন, ফলাফল দেওয়ার পর কায়সারের লোকজন ব্যালট ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে কায়সারের সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশ ও আনসারের সংঘর্ষ হয়।
পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্র জানায়, পিরোজপুর ইউপির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর গতকাল ছিল উপনির্বাচন। এতে কায়সার আহম্মেদ ও আব্দুল আজিজ সরকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কোনো বিশৃঙ্খলা ছাড়াই ভোটগ্রহণ শেষ হয়। ভোট গণনায় কায়সার পরাজিত হন। তিনি গণনা নিয়ে আপত্তি তোলেন। আবার গণনা করলেও তিনি হেরে যান। এ নিয়ে কায়সারের লোকজনের সঙ্গে পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ২০ জন আহত হন।
এদিকে গতকালের ঘটনায় আজ দুপুর পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। পুলিশের ওপর হামলা ও একজন নিহতের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম কামরুজ্জামান আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি। নিহত হৃদয়ের স্বজনদের পক্ষ থেকে একটি হত্যা মামলা হচ্ছে। পুলিশ বাদী হয়ে আরও একটি মামলা করবে।