মা ও দুই ভাইকে হারিয়ে শিশু ওজিহা এখন চাচাতো বোনদের কোলে

জেকি আক্তারের কোলে সাত মাসের শিশুসন্তান ওজিহা। পাশে জেকির বড় ছেলে মাহিন
ছবি: সংগৃহীত

একটি কক্ষের বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল সাত মাস বয়সী শিশু ওজিহা। পাশের কক্ষের মেঝেতে ছিল মা জেকি আক্তার ও বড় ভাই মাহিনের লাশ এবং পাশের শৌচাগারে ছিল ছোট ভাই মহিনের রক্তাক্ত লাশ। গৃহপরিচারিকা ও স্বজনেরা দরজা ভেঙে এমন দৃশ্য দেখতে পান। তখন ওজিহার শরীরজুড়ে ছিল মলমূত্র।

আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে ঘরের দরজা ভেঙে ভেতর থেকে রক্তাক্ত ওই তিনটি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সাত মাস বয়সী শিশু ওজিহাকে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়।

নিহতরা হলেন উপজেলার আইয়ুবপুর ইউনিয়নের চরছয়ানী দক্ষিণপাড়া গ্রামের সৌদিপ্রবাসী শাহ আলমের স্ত্রী জেকি আক্তার (৪০), তাঁদের দুই ছেলে মাহিন ইসলাম (১৬) ও মহিন ইসলাম (৬)।

আজ বিকেলে পাঁচটার দিকে ওই বাড়িতে দেখা যায়, ঘরে-বাইরে মানুষের ভিড়। প্রতিবেশী ও আশপাশের এলাকা থেকে লোকজন ভিড় করছেন শিশু ওজিহাকে একনজর দেখতে। লোকচক্ষু থেকে শিশুটিকে আড়ালে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন স্বজনেরা।

শাহ আলমের চাচাতো ভাই আশরাফ উদ্দিনের ঘরে শিশু ওজিহাকে পাওয়া যায়। শিশুটির চাচাতো বোন পাপিয়া আক্তার তাকে কোলে করে খাবার খাওয়াচ্ছিলেন। পাপিয়া আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেলা একটা থেকে শিশু ওজিহা আমাদের ঘরে। দুপুর থেকে অনেক কান্নাকাটি করছে ওজিহা। কোনোরকমে তাকে শান্ত করেছি। এলাকার মানুষ জড়ো হয়েছেন বাড়িতে। তাই তাকে আড়াল করে রেখেছি আমরা। এরপরও তাকে দেখতে মানুষের ভিড় জমেছে।’ ওজিহা এখন কার সঙ্গে থাকবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওর দাদা আছে। তাঁদের সঙ্গে থাকবে। তা ছাড়া ওর বাবা সৌদি আরব থেকে রওনা হয়েছে।’

চাচাতো ভাই জাহাঙ্গীর আলমের কোলে শিশু ওজিহা। মঙ্গলবার বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার চরছয়ানী গ্রামে

পাশেই ছিলেন শিশুটির আরেক চাচাতো বোন আঁখি মনি। তিনি বলেন, ‘সকাল ১০টার সময় আমি ওজিহাকে কোলে নিই। এর পর থেকে দুপুর পর্যন্ত ওজিহা আমার কাছে ছিল। সকালে ওজিহা পাশের একটি ঘরে বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল। শরীরজুড়ে নিজের মলমূত্র লেগেছিল।’

কিছুক্ষণ পর ওই ঘরে ঢোকেন ওজিহার চাচাতো ভাই জাহাঙ্গীর আলম। তিনি ওজিহাকে কোলে তুলে নেন। তিনি বলেন, ‘আমি মাত্র ঢাকা থেকে এসেছি। ওর জন্য খারাপ লাগছে। কোলের শিশুটি মা ও তার দুই ভাইকে হারাল। পাশের ঘরে ছিল বলেই হয়তো ওজিহা বেঁচে গেছে।’

ওজিহার দাদা সুলতান সরকার বলেন, ‘আমার নাতনি ওজিহা এখন আমাদের কাছে থাকবে। আমার ছেলে এরশাদের স্ত্রী খালেদা আক্তার তাকে দেখাশোনা করবে। আর ওর বাবা আমার ছেলে শাহ আলম দেশের উদ্দেশে রওনা হয়েছে।’

দুই ছেলে ও এক মেয়েসন্তান নিয়ে চরছয়ানী গ্রামের একটি পাকা ভবনে বসবাস করতেন সৌদিপ্রবাসী শাহ আলমের স্ত্রী জেকি আক্তার। আজ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জেকি আক্তারের বাসায় যান গৃহপরিচারিকা জেসমিন আক্তার। এ সময় জেকি আক্তারের বাড়ির প্রধান ফটকে তালা ও ভেতরের দরজা বন্ধ থাকায় কলিং বেল চাপেন জেসমিন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা ও ডাকাডাকি করেও ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাননি তিনি। দরজা না খোলায় জেসি আক্তারের পাশের বাড়িতে থাকা স্বজন ইয়াসমিন আক্তারের কাছ থেকে চাবি নিয়ে প্রধান ফটক খোলেন তাঁরা। এ সময় ভেতরে গিয়ে ভবনের সব দরজা-জানালা বন্ধ দেখতে পান তাঁরা। পরে আশপাশের লোকজন জড়ো হয়ে বিষয়টি বাঞ্ছারামপুর থানা-পুলিশকে জানান।

প্রবাসী শাহ আলমের স্ত্রী ও দুই সন্তানকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় বাড়ির সামনে ভিড় করেন লোকজন। মঙ্গলবার বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার চরছয়ানী গ্রামে

খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে দরজা ভেঙে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে মেঝেতে জেকি ও তাঁর বড় ছেলে মাহিনের লাশ এবং পাশের শৌচাগারে ছোট ছেলে মহিনের রক্তাক্ত লাশ দেখতে পান। এ সময় সাত মাস বয়সী কন্যাসন্তান ওজিহাকে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়।

আইয়ুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাড়ির চারপাশে দেয়াল আছে। বাড়িতে দুটি পাকা ভবন। পূর্ব পাশের ভবনে প্রবাসী শাহ আলমের পরিবার বসবাস করে। কলাপসিবল গেটসহ দরজা ও জানালা সব বন্ধ ছিল। ঘরের ভেতরের মেঝে রক্তে ভেসে গেছে। জেকি আক্তারকে খুন করার পর চিনে ফেলায় হয়তো দুই ছেলেকে তারা খুন করে বলে মনে হচ্ছে। খুন করার পর সম্ভবত দ্বিতীয় তলার ছাদসংলগ্ন আমগাছ দিয়ে তারা নেমে পালিয়ে গেছে। কারণ, সেখানে রক্তের ছাপ রয়েছে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নবীনগর সার্কেল) মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিহত গৃহবধূর এক জাসহ তিনজনকে থানায় নেওয়া হয়েছে। ঘটনায় কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া না গেলে মুচলেকা নিয়ে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হবে। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো মামলা করা হয়নি। পুলিশের একাধিক দল ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটনে কাজ করছে।