তেঁতুলতলার চরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কয়রা নদী। গত শুক্রবার তোলা
তেঁতুলতলার চরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কয়রা নদী। গত শুক্রবার তোলা

জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ, যেভাবে দিন কাটে তেঁতুলতলার চরের বাসিন্দাদের

ওপারে সুন্দরবন, এপারে কয়রা নদীর বিশাল একটি চর। নাম তেঁতুলতলার চর। সেখানে অনেক খুঁজেও কোথাও তেঁতুলগাছের দেখা মিলল না, তবু কী কারণে এমন নাম, তা কারও কাছেই জানা গেল না। পাঁচ শতাধিক মানুষের বসবাস চরটিতে। বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা অনেকটাই সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। এককথায় তাঁরা বনজীবী। এসব মানুষ নিয়ে তেঁতুলতলার চরের একটি অংশে গড়ে উঠেছে ‘বনজীবীপাড়া’।

খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবনঘেঁষা মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের ‍৬ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে তেঁতুলতলার চর। সেখানে কান পাতলেই শোনা যায় হরেক পাখির কোলাহল, পশুর ডাক, কখনো আবার বাঘের গর্জন। এ পাড়ার মানুষের কাছে এসব আওয়াজ খুবই চেনা। ভয় আছে কুমিরেরও। তা সত্ত্বেও মাথা গোঁজার কোনো বিকল্প না পেয়ে সুবিধাবঞ্চিত চরে বাধ্য হয়ে বসত গড়েছেন। নদীভাঙনে সহায়-সম্পদ হারানোর পর কেউ ছিলেন রাস্তার ধারে, কেউ অন্যের জমিতে। অবশেষে চরটিতে ঠাঁই মিলেছে তাঁদের।

চিংড়িঘেরের আল ধরে হাঁটছি। এক পাশে লোকালয়, আরেক পাশে সুন্দরবন। মাঝখানে বয়ে গেছে প্রায় ১০০ মিটার প্রশস্ত কয়রা নদী। প্রায় পুরো এলাকায় চিংড়ির ঘের। অবস্থানগত কারণে তেঁতুলতলার চরের মানুষের ভোগান্তিটা একটু বেশিই মনে হলো। চরের ঘরবাড়ির কাছাকাছি যেতেই উদোম শরীরে হন হন করে ছুটে এলেন মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি। পরনে সবুজ চেক লুঙ্গি। রোদে পোড়া শরীর। উষ্কখুষ্ক চুল। জবা ফুলের মতো লাল চোখ জোড়া যেন ঠিকরে বেরোতে চাইছে। জানতে চাই, ‘চোখ দুটো এত লাল কেন?’ জবাব এল, প্রায় সারা রাত জেগে লোনাজল দাবড়ে মাছ ধরেছেন, তাই এমন দশা। সুন্দরবন-সংলগ্ন নদীতে একাই ডিঙিনৌকা ভাসিয়ে সারা রাতের শ্রমের বিনিময়ে পেয়েছেন মাত্র ৪০০ টাকা। অপরিচিত মুখ দেখে চরে আসার কারণ জানতেই ছুটে এসেছেন আসলাম মোড়ল নামের এই ব্যক্তি।

আসলাম মোড়লের সঙ্গে কথা চলতেই থাকে। কথার জোয়ারে ভাসতে ভাসতে একসময় পৌঁছে গেলাম বনজীবীপাড়ায়। পাড়ায় গাদাগাদি করে তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি ঝুপড়ি। আর পাশেই নদীর ওপর বানানো হয়েছে ঝুলন্ত শৌচাগার। কয়েকটি ঘরের পাশেই আছড়ে পড়ছে নদীর ঢেউ। নদীতে সামান্য পানি বাড়লেই অঞ্চলটির বাসিন্দাদের বসবাস বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কোনো কোনো ঘরের পেছনে নদীর পাড় ক্রমাগতভাবে ভাঙছে।

মাথা গোঁজার কোনো বিকল্প না পেয়ে সুবিধাবঞ্চিত চরে বাধ্য হয়ে বসত গড়েছেন। নদীভাঙনে সহায়-সম্পদ হারানোর পর কেউ ছিলেন রাস্তার ধারে, কেউ অন্যের জমিতে। অবশেষে তেঁতুলতলার চরে ঠাঁই মিলেছে তাঁদের।

নদীতে নৌকা নিয়ে চলাচলের সময় ঘরগুলোর বাসিন্দাদের দেখা যায়, কান পাতলে তাঁদের কথাও শোনা যায়। ঘরগুলোর মেঝে একেবারে এবড়োখেবড়ো। বাঁশ-খুঁটির ওপর চাল, বাঁশের চাটাই ও গোলপাতার বেড়া দিয়ে কোনোটি, আবার কোনোটি তৈরি হয়েছে মাটি দিয়ে। এসব দেয়াল ঢাকা হয়েছে গোলপাতায় কিংবা ত্রাণে পাওয়া টিনে। কতবার যে ঝড়ঝাপটায় ঘরের চালা উল্টে গেছে, দেয়াল ধসে পড়েছে, তার সঠিক হিসাব নেই এসব বাসিন্দার কাছে।

৩০ বছর ধরে বনজীবীপাড়ায় বাস করছেন ৭১ বছর বয়সী লক্ষ্মীন্দর দাস। চাপা কষ্ট নিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ—এসব তেঁতুলতলার চরের প্রধান সমস্যা। খাওয়ার পানির তীব্র সংকট রয়েছে। চরটিতে আয়রোজগারের পর্যাপ্ত উপায় নেই। ফলে বছরের বেশির ভাগ সময় ধারদেনা করে চলতে হয় বাসিন্দাদের।
আর্থিক কষ্টের সঙ্গে বাসিন্দারা এখানে প্রকৃতির শক্তির কাছে হার মানার কষ্টও মেনে নিয়েছেন। তবু তাঁরা আঁকড়ে ধরে থাকতে চান তেঁতুলতলা চরের মাটি।  

মাথা গোঁজার কোনো বিকল্প না পেয়ে সুবিধাবঞ্চিত চরে বাধ্য হয়ে বসত গড়েছেন অনেকে

বৃদ্ধ লক্ষ্মীন্দর দাস জানান, তেঁতুলতলার চরের বনজীবীপাড়ার জায়গার মালিক বন বিভাগ। কিছু অংশ আবার পড়ছে পাউবোর জমিতে। অন্য কোথাও নিজেদের জমি না থাকায় ঝড়ঝঞ্ঝা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সয়েও তাঁরা এখানে আছেন। অন্য কোথাও নিজেদের জমি না থাকায় ঝড়ঝঞ্ঝা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সয়েও তাঁরা এখানের মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন।

২০০৯ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আইলায় পাড়াটি একেবারে তলিয়ে গিয়েছিল। লক্ষ্মীন্দর তখন বাড়িতেই ছিলেন। বাড়ির অন্য সদস্যদের দূরের আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়ে সেখানে একাই ছিলেন তিনি। একপর্যায়ে পানির তোড়ে ডুবে যায় তাঁর ঘর। নিজেকে বাঁচাতে একটি গাছে চড়েন। সেখানে গাছের ডালে নিজেকে বেঁধে রেখেছিলেন বলে দাবি করেন লক্ষ্মীন্দর।

লক্ষ্মীন্দরের কথার সূত্র ধরে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিবপ্রদ দাস বলেন, ‘এই পাড়ার কমবেশি সব্বার এই অভিজ্ঞতা আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর নদীর লোনাপানির সঙ্গে লড়াই করে আমরা টিকে আছি।’

এভাবে কি জীবন চলে?’ শিবপদ দাসের খুবই সাদাসিধে উত্তর, ‘কী আর করব। জন্মেছি সুন্দরবনের জেলের ঘরে। বাবাকে দেখেছি মাছ ধরতে, বনে যেতে, মধু কাটতে, কখনো কখনো নৌকায় দিনমজুর হিসেবে।’

বাবার কাছ থেকেই এসব কাজ শিখেছেন শিবপদ। তিনি জানান, অঞ্চলটির অনেক বাসিন্দা অনুমতি নিয়ে মাছ-কাঁকড়া সংগ্রহ করতে বনের ভেতরে যান। তবে এখন অনেকেই আর বনে যেতে চান না। যদি নিয়মিত কোনো কাজ পাওয়া যেত, তাহলে অধিকাংশ বাসিন্দাই আর বনে যেতেন না বলে মনে করেন শিবপদ।
খানিক বাদে চিংড়ির পোনা ধরে বাড়ি ফিরছিলেন বনজীবীপাড়ার শরিফা বেগম। দেখা হতেই তিনি বলেন, ‘কী করব—এ না করলে পেট চলবে ক্যামনে? আমরা যে কীভাবে বেঁচে আছি, খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই।’

তেঁতুলতলার চরের বনজীবীপাড়ায় অনেক সমস্যা আছে। যতটা সম্ভব সমাধানের চেষ্টা করা হয়। আরও বরাদ্দের জন্য আমরা চেষ্টা করছি।
শাহনেওয়াজ শিকারী, চেয়ারম্যান, মহেশ্বরীপুর ইউপি

তবে নির্বাচন এলে বাসিন্দারা ভোট দেন। কেউ কেউ ছবিতে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে দেখেছেন বলে জানান। তবে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে তাঁরা স্বচক্ষে দেখেছেন। চেয়ারম্যান কিংবা মেম্বারের কাছে সমস্যার কথাও অনেক বলেছেন। তবে সমাধান হয়নি।

মহেশ্বরীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারী বলেন, ‘তেঁতুলতলার চরের বনজীবীপাড়ায় অনেক সমস্যা আছে। যতটা সম্ভব সমাধানের চেষ্টা করা হয়। আরও বরাদ্দের জন্য আমরা চেষ্টা করছি।’

শুধু আশ্বাস নয়, চরের বাসিন্দারা নাগরিক সুবিধাও চান। তাঁরা বলেছেন, এখানে থাকার তেমন পরিবেশ নেই। অন্যত্র যেতেও পারছেন না। চরটিতে উন্নয়ন সম্ভব না হলে তাঁদের অন্যত্র সরানোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন বনজীবীপাড়ার বাসিন্দারা।

শিবপদ দাসও স্বপ্ন দেখেন, চরটির পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তাদের পূর্ববর্তীদের পথে না হাঁটুক। তাদের জীবন হোক সুন্দর এবং স্বাভাবিক।