বরিশাল সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত নিজের মতো করে মাঠ গোছাচ্ছেন। তাঁর প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে নির্বাচনের আমেজ থাকলেও দলের জেলা ও মহানগর এমনকি ওয়ার্ড কার্যালয়ে নেই কোনো তৎপরতা। কার্যালয়গুলো বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে। মাঝেমধ্যে খোলা হলেও সেখানে নেতা-কর্মীদের আনাগোনা কম। অথচ ২০১৮ সালে নির্বাচনের সময় দলীয় কার্যালয়গুলো ছিল সরগরম।
খায়ের আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ নেতারা বলছেন, ইতিমধ্যে ৩০টি ওয়ার্ডে নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি করে কমিটি করা হয়েছে। একইভাবে ১২৪টি কেন্দ্রের জন্য কমিটি করার কার্যক্রম চলমান। দলের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত না হয়ে বরং ভাবলেশহীন আছেন। এমন পরিস্থিতিতে দলীয় প্রার্থী তাঁর সমর্থক নেতাদের নিয়েই এগোচ্ছেন।
চারটি ওয়ার্ডের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ওয়ার্ড পর্যায়ে যেসব কমিটি করা হয়েছে, সেখানে তাঁদের ডাকা হয়নি। নামও রাখা হয়নি। নিয়ম হচ্ছে প্রতি ওয়ার্ডে যে কমিটি হবে, তার প্রধান হবে ওয়ার্ড সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক হবেন সমন্বয়ক। এ জন্য ওয়ার্ডের নেতারা নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছেন না। হলেও দায়িত্ব না থাকায় তেমন ভূমিকা রাখার সুযোগ পাবেন না।
রোববার নগরের সার্কিট হাউসের বিপরীতে খায়ের আবদুল্লাহর প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের ভিড়। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কর্মীদের দিনের কাজ বণ্টন করছেন। তবে নগরের সদর রোডে সোহেল চত্বরে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়টি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়।
২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনে সাদিক আবদুল্লাহর নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা হতো এখান থেকেই। দিন-রাত কার্যালয়টি সরগরম থাকত। নগরের ওয়ার্ড কার্যালয়গুলোতেও নেতা-কর্মীদের সরব উপস্থিতি দেখা যেত। কিন্তু এবার চিত্র পুরোটাই উল্টো। নগরের বগুড়া রোডে ১৮ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয় খোলা থাকলেও সেখানে নেতা-কর্মীদের দেখা যায়নি।
খায়ের আবদুল্লাহর নির্বাচন পরিচালনা কমিটি সূত্র জানায়, ৩০টি ওয়ার্ডে যে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করা হয়েছে, সেখানে সাদিক আবদুল্লাহর অনুগতদের রাখা হয়নি। সাদিকের সঙ্গে দূরত্ব ছিল এমন কয়েকজন নেতাকে কয়েকটি ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। বাকিরা সবাই দল থেকে ছিটকে পড়া সাবেক নেতা-কর্মী।
তবে ২৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হুমায়ুন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দল করি। তাই দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে থাকব, তাঁকে জয়ী করতে কাজ করব। যাঁরা দল করেন সবাই নামবেন। আমাদের নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর অপেক্ষা করছেন সবাই। শিগগিরই তিনি এসে আমাদের নিয়ে সভা করে দিকনির্দেশনা দেবেন।’
বরিশালে এবার দলীয় মনোনয়ন পাননি বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ। মনোনয়ন পেয়েছেন তাঁর ছোট চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ। এতে শুরু থেকেই সাদিক আবদুল্লাহর পক্ষে থাকা মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা দলীয় প্রার্থীর ব্যাপারে নির্লিপ্ত। মনোনয়ন ঘোষণার পর এক মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও তাঁরা এখনো প্রার্থীর পক্ষে দাঁড়াননি।
দলীয় সূত্র জানায়, বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগ ও নগরের ৩০টি ওয়ার্ড কমিটির নেতাদের বেশির ভাগই সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী। অন্যদিকে সাদিক আবদুল্লাহর বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ায় তাঁরাও সাদিক আবদুল্লাহর পক্ষে। দলীয় মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগে যে অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছিল, তাতে কিছুটা ‘স্বস্তি’ এনেছিল ১৭ মে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে প্রধান করে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠনের পর। কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে ওই কমিটি গঠন করে আওয়ামী লীগ। এটিকে উভয় পক্ষ ইতিবাচক বলে মন্তব্য করলেও বিভেদ নিরসনের কোনো আলামত এখনো দেখা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে জেলা ও মহানগরে এক মাসের বেশি সময় ধরে বলে আসছেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও সাদিক আবদুল্লাহ বরিশালে আসার পর যৌথ সভা করে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নামবেন। কিন্তু সেই সভা কবে হবে এবং হাসানাত আবদুল্লাহ কবে নাগাদ বরিশালে আসবেন, সেই প্রশ্নের উত্তর তাঁদের কাছে নেই।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে বরিশালে আসবেন। এরপর যৌথ সভা করে আমরা মাঠে নামব।’ তবে কবে নাগাদ তিনি আসবেন, তা সুনির্দিষ্ট করে জানাতে পারেননি এই নেতা। ওয়ার্ড নেতাদের দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নামার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, আমরা এখনো কোনো নির্দেশনা দিইনি। যৌথ সভার পরে দেব। কারণ আমরা দলীয় কাঠামোর মধ্য দিয়েই সব সিদ্ধান্ত নিতে চাই। আচরণবিধি যাতে লঙ্ঘিত না হয়, সে বিষয়টি মাথায় রেখেই যা করার করা হবে।’
দলের একটি পক্ষ বলছে, হাসানাত আবদুল্লাহ আদৌ বরিশালে আসবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় বাড়ছে। ওই পক্ষটির দাবি, নির্বাচনের দিনক্ষণ এগিয়ে আসছে। ২৬ মে থেকে প্রচার-প্রচারণা শুরু হবে। তার আগে অনেক প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। এরপর দল সম্পৃক্ত হলেও গা ছাড়া মনোভাবের শিকার হতে পারেন খায়ের আবদুল্লাহ। তবে খায়ের আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠরা বলছেন, সেই বিষয়টি মাথায় রেখে তাঁরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
খায়ের আবদুল্লাহর নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে আছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক লস্কর নুরুল হক। তিনি বলেন, ‘আমরা একটি নির্বাচন পরিচালনায় যত ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন, সবই নিচ্ছি। যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের থাকবে।’ তিনি বলেন, ইতিমধ্যে ৩০টি ওয়ার্ডে কমিটি করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে নির্বাচনী কার্যালয় হবে। ১২৪টি কেন্দ্র কমিটির কাজ চলছে। সবকিছু পরিকল্পনামাফিক করা হচ্ছে।