কক্সবাজার উপকূলের লবণচাষিরা এবার লবণ উৎপাদনে রেকর্ড করেছেন। মঙ্গলবার পর্যন্ত চলতি মৌসুমের সাড়ে ৪ মাসে জেলার ৬৬ হাজার একরের বেশি জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ মেট্রিক টন। বিসিকের তথ্যমতে, এর আগে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের রেকর্ড ছিল ২০২১ সালে।
আরেকটি রেকর্ড হওয়ার সম্ভাবনা আছে। লবণের মৌসুম শেষ হতে আরও ২০ দিন আছে। এ সময়ের মধ্যে আরও ৪ থেকে ৫ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন করা সম্ভব হলে দেশের ১৭ কোটি মানুষের বার্ষিক চাহিদা পূরণ হবে। লবণের বার্ষিক চাহিদা ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। এ পরিমাণ লবণ উৎপাদন সম্ভব হলে সেটি হবে বাণিজ্যিকভাবে লবণ উৎপাদন শুরুর ৬২ বছরে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, জেলায় বাণিজ্যিক লবণ উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬০ সালে। চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদন বাড়ার কারণের মধ্যে আছে মৌসুমজুড়ে দাবদাহ পরিস্থিতি, কম বৃষ্টিপাত এবং ৬৬ হাজার একর জমির শতভাগে আধুনিক পলিথিন প্রযুক্তিতে চাষাবাদ। সনাতন পদ্ধতির তুলনায় পলিথিন প্রযুক্তিতে আড়াই গুণ লবণ বেশি উৎপাদন হয়।
বিসিকের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত পাঁচ মাস) কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, রামু ও বাঁশখালী উপজেলার ৬৬ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ উৎপাদন করা হচ্ছে। এসব জমিতে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাড়ে ৪ মাসে লবণ উৎপাদিত হয়েছে ১৮ লাখ ৩৮ হাজার ৫২৭ মেট্রিক টন। বুধবারের ২০ হাজার মেট্রিক টন যোগ করলে মোট উৎপাদন দাঁড়াবে ১৮ লাখ ৫৮ হাজার ৫২৭ মেট্রিক টনে, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ লবণ উৎপাদনের রেকর্ড।
বিসিক কর্মকর্তা ও চাষিরা বলেন, চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদনের জন্য আরও ২০ দিন (১৫ মে পর্যন্ত) সময় হাতে আছে। তবে এ সময়ের মধ্যে ঝড়-বৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা আছে। অন্তত সাত থেকে আট দিন সূর্যের তাপ কিংবা রোদ পাওয়া গেলে আরও তিন থেকে চার লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। তখন সর্বমোট ২২ লাখ মেট্রিক টনের বেশি উৎপাদিত লবণ দিয়ে দেশের ১৭ কোটি মানুষের বার্ষিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে।
বিসিক লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী প্রথম আলোকে বলেন, ২০২০ সালে যখন লবণনীতি করা হয়, তখন দেশের লোকসংখ্যা ১৮ কোটি ধরে লবণের বার্ষিক চাহিদা ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়। এখন আদমশুমারিতে দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। এ ক্ষেত্রে ২০ লাখ মেট্রিক টন লবণ দিয়ে ১৭ কোটি মানুষের বার্ষিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
কয়েকজন চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৩–১৪ দিন ধরে কক্সবাজার উপকূলে প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে। মাঠে জমানো সমুদ্রের লোনাপানি দ্রুত শুকিয়ে লবণ তৈরি হচ্ছে। গত কয়েক দিন মাঝেমধ্যে আকাশে কালো মেঘ দেখা গেলেও বৃষ্টি হয়নি। তবে পুরো মৌসুমজুড়ে ৩ দফার বৃষ্টিতে ১৫–২০ দিন মাঠের লবণ উৎপাদন বন্ধ ছিল।
দাবদাহে এখন জেলার ৬০ হাজার একরের বেশি জমিতে দৈনিক উৎপাদিত হচ্ছে ২২-২৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ।
বিসিকের কর্মকর্তা মো. ইদ্রিস আলী বলেন, বর্তমানে মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ৪২০-৪৩০ টাকায়। ন্যায্যমূল্য পাওয়ায় চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে বেশ খুশি।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের খারাংখালীর চাষি রহমত উল্লাহ (৫০) বলেন, প্রচণ্ড দাবদাহ পরিস্থিতিতে লবণের বাম্পার উৎপাদন হচ্ছে। প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ৪২০ টাকায়।
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, দাবদাহ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হলেও লবণচাষিদের কপাল খুলে যাচ্ছে। লবণের দামও বেশি পাচ্ছেন। গত মৌসুমে প্রতি মণ লবণ বেচাবিক্রি হয়েছিল ২৮০ টাকায়, এবার ৪২০ টাকার বেশি।
কক্সবাজারের পিএমখালীর চাষি নুরুল ইসলাম (৪৭) বলেন, মাঠে লবণের বাম্পার উৎপাদন হলেও মনে আতঙ্ক থেকে গেছে। কারণ, আকাশে মাঝেমধ্যে কালো মেঘ জমছে। যেকোনো মুহূর্তে ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে। তখন লবণ উৎপাদন ব্যাহত হবে।
বাংলাদেশ লবণ চাষি সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও মহেশখালীর লবণচাষি আনোয়ার পাশা চৌধুরী বলেন, ঝড়–বৃষ্টির শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও চাষিরা মাঠ ছাড়ছেন না। ঝুঁকি নিয়ে লবণ উৎপাদন চালিয়ে গেলেও চাষিরা লবণের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। চাষিদের চাওয়া, প্রতি মণ লবণের দাম ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হোক।
বিসিকের তথ্যমতে, প্রায় ৪৫ হাজার প্রান্তিক চাষি, ১ লাখ শ্রমিকসহ জেলার অন্তত ১০ লাখ মানুষ লবণ উৎপাদন, বিপণন, পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।