টিনশেডের ছোট্ট একটা ঘর। আঙিনায় পড়ে আছেন শিকলবন্দী দুই বোন। তাঁদের নাম পপি আক্তার (২০) ও ইসমত আরা (১৬)। মানুষজন দেখলে পপি কিছুটা হইচই করেন, তবে ইসমত বেশ চুপচাপ। কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের নয়াকাটা গ্রামের বাসিন্দা তাহেরা বেগমের দুই মেয়ে তাঁরা। জন্মের পর থেকেই দুই বোন মানসিক ভারসাম্যহীন।
নয়াকাটা গ্রামে তাহেরা বেগমের (৪৫) দুই কক্ষের ছোট্ট টিনের ঘর। ঘরটিও বছরখানেক আগে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশনের সহায়তায় তৈরি করা। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ গরিব, লবণশ্রমিক। তাহেরা নিজেও মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালান।
তাহেরা বেগম বলেন, জন্মের পর থেকে পপি ও ইসমত মানসিক ভারসাম্যহীন। গ্রামের লোকজন বলেন, তাঁদের জিনে ধরেছে। তখন গ্রামের কবিরাজের কাছে নেওয়া হয়, চিকিৎসক দেখানো হয় কয়েকবার। কিন্তু কাজ হয়নি। পপি কারও কথা শুনতে পান না, কিন্তু নিজে নিজে অনবরত কথা বলতে থাকেন। খাবারও খাইয়ে দিতে হয়। গোসল, কাপড়চোপড় পরানো—সবকিছুই করে দিতে হয় তাঁদের। দুই মেয়েকে চট্টগ্রামে নিয়ে একবার চিকিৎসক দেখিয়েছিলেন। গর্ভে থাকতেই দুই মেয়ের মস্তিষ্কে সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে জানান চিকিৎসক। এই রোগ সহজে সেরে ওঠে না। উন্নত চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য তাঁদের নেই।
পপি ও ইসমতের রোগের বর্ণনা শুনে কুতুবদিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা নাদিম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা জন্মগত অটিস্টিক সন্তান। অটিজমে আক্রান্তদের বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন। তাঁদের চিকিৎসায় তেমন উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
তাহেরা বেগমের সংসারে এক ছেলে তিন মেয়ে। বড় ছেলে মিরাজ (২২) সাগরে মাছ ধরে সংসার চালান। গত কয়েক মাস সাগরে মাছ ধরা পড়ছে না, আয়রোজগার নেই বললে চলে। ছোট মেয়ে তাসমিনা আক্তার (১০) পড়ছে বাড়ির পাশের নাজির কবির ইসলামিয়া একাডেমির পঞ্চম শ্রেণিতে। সেও মাঝেমধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ করে। স্বামী ইউসুফ আলী (৫৫) হাঁপানির রোগী। কয়েক বছর ধরে বেকার। আগে তিনি লবণের মাঠে শ্রমিকের কাজ করতেন।
সকাল থেকে পপি ও ইসমতকে শিকলবন্দী করে রাখা হয়। ঘরের পাশ দিয়ে হাঁটাচলার একটি কাঁচা রাস্তা আছে। হেঁটে যাওয়া লোকজন দেখলে পপি চিৎকার করেন। তবে ইসমত একেবারে চুপচাপ, মাথা নিচু করে বসে থাকে। সন্ধ্যার আগেভাগে দুই মেয়েকে ঘরের ভেতরের একটি কক্ষে বন্দী করে রাখেন মা। সেখানেই কাটে তাঁদের রাত। শীত অথবা ঠান্ডা বাতাস ঠেকানোর মতো গরম জামাও দুজনের নেই।
বড় মেয়ের জন্মের পর থেকে টানা ২০ বছর এমন লড়াই করে যাচ্ছেন তাহেরা বেগম। তিনি বলেন, ‘এমন কষ্ট আল্লাহ যেন অন্য কাউকে না দেন। দুই মেয়েকে সামলাতে আমাকে হিমশিম খেতে হয়। মাঝেমধ্যে পায়ের শিকল খুলে পপি ও ইসমত এদিক–সেদিক পালিয়ে যায়। পরে তাদের খুঁজে এনে আবার শিকল পরিয়ে দিই। রাতেও দুজনের পায়ে শিকল বাঁধা থাকে। রাতবিরাতে ঘুম থেকে উঠে দুই বোন চিল্লাচিল্লি করে। তখন আমার ঘুমও ভেঙে যায়। শীত ও বর্ষাকালে দুই মেয়েকে নিয়ে কষ্টের সীমা ছাড়িয়ে যায়। পপি-ইসমতের ভাগ্য আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। যত দিন শরীরে প্রাণ থাকবে, তাদের ছেড়ে যাব না।’
ঘরের রান্নাবান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, লোকজনের বাড়িতে কাজ করে আয়রোজগারের পথ খোঁজা থেকে শুরু করে সব কাজ সামলাতে হয় তাহেরাকে। দীর্ঘদিন নির্ঘুম থাকতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। পারিবারিক দুর্দশার কথা তুলে ধরে তাহেরা বলেন, আগের দিন সকালে তাঁরা নাশতা করেছেন ডাল আর ভাত দিয়ে। দুপুরের খাবারও ডাল-ভাত দিয়ে। রাতে খেয়েছেন ডালের পরিবর্তে শাক। গত কয়েক মাস এভাবেই কাটছে তাঁদের জীবন। পপি আক্তার প্রতিবন্ধী ভাতা পেলেও বয়স কম থাকায় বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন না তাহেরা বেগমের স্বামী ইউসুফ আলী।
উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের ইউপি সদস্য নাসির উদ্দিন বলেন, হতদরিদ্র পরিবার হলেও তাহেরা মনোবল হারাননি। নয়াকাটা গ্রামসহ উত্তর ধুরুং ইউনিয়নে হতদরিদ্র মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে কাজ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশন। এই সংস্থার সমৃদ্ধি কর্মসূচির আওতায় গত কয়েক বছরে ইউনিয়নের ৮ জন ভিক্ষুক, ১৩টি প্রতিবন্ধী পরিবারকে অর্থসহায়তা দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এর মধ্যে তাহেরার পরিবারও আছে।
কোস্ট ফাউন্ডেশনের সমৃদ্ধি কর্মসূচির প্রকল্প সমন্বয়ক ফজলুল হক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে এই উপকূলের মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পেশা হারিয়ে অনেকে দিশাহারা। তাহেরাকে ৪০ হাজার টাকার অর্থসহায়তা দেওয়া হয়েছে। এই টাকা খরচ হয় ঘর তৈরি এবং দুই মেয়ের চিকিৎসায়। উন্নত চিকিৎসা পেলে হয়তো দুই মেয়ে নতুন জীবন ফিরে পেতেন।