টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথ

এবার পর্যটন মৌসুমে বন্ধ থাকছে জাহাজ চলাচল

টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে পর্যটকবাহী জাহাজ
ফাইল ছবি

একদিকে টেকনাফ উপকূল, অন্যদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। পেছনে সঙ্গী হয়ে উড়াল দিয়েছে একঝাঁক গাঙচিল। কক্সবাজারের টেকনাফের দমদমিয়া ঘাট থেকে জাহাজে করে প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনে যেতে এমন দৃশ্যই এত দিন প্রাণ জুড়িয়েছে পর্যটকদের। তবে এবার পর্যটন মৌসুমে সেই দৃশ্য দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন পর্যটকেরা।

মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি ও নাফ নদীর বিভিন্ন স্থানে ডুবোচর দেখা দেওয়ায় জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে জাহাজে করে সাগরপথে সেন্ট মার্টিন যেতে পারবেন পর্যটকেরা।

জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জানায়, প্রতিবছর সাধারণত অক্টোবর থেকে সেন্ট মার্টিন রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হয়। এ বছরও তাই সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে জাহাজ চলাচলের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন জাহাজমালিকেরা। কিন্তু এর মধ্যেই স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজারে আয়োজিত এক সেমিনারেও পর্যটন সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।

জাহাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন টেকনাফ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. এরফানুল হক চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথের নাফ নদীর মোহনা ও মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকায় একাধিক ডুবোচর জেগে ওঠায় নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পর্যটক নিয়ে জাহাজ ডুবোচরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা পড়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। ডুবোচরে আটকা পড়ে গত এপ্রিল ও মে মাসে মিয়ানমার থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে আমদানি করা পণ্য নিয়ে আসা ট্রলারের মধ্যে কাঠভর্তি সাতটির বেশি ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটে। সব দিক বিবেচনা করে এবার টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা হচ্ছে।

৬ অক্টোবর থেকে কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছটার বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে ছাড়া হবে ৬৩২ জন ধারণক্ষমতার জাহাজ এমভি কর্ণফুলী। একই ঘাটে ১৫ অক্টোবর থেকে ছাড়বে ৫৫০ জন ধারণক্ষমতার এমভি বারো আউলিয়া।

তবে স্থানীয় প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায়, ডুবোচরের কথা বলা হলেও মূলত মিয়ানমার সীমান্তে সেখানকার সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংঘর্ষের কারণে টেকনাফ থেকে জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।

জাহাজ মালিকদের সংগঠন সি-ক্রুজ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (স্কোয়াব) সভাপতি তোফায়েল আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত দুই মাস মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী আরকান আর্মির (এএ) সংঘর্ষ চলছে। গুলি কিংবা মর্টার শেল জাহাজে এসে পড়লে প্রাণহানির শঙ্কা থাকে। এ ছাড়া নাফ নদীর বদর মোকামসহ বিভিন্ন পয়েন্টে একাধিক ডুবোচরও জেগে উঠেছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে আপাতত পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকবে। আমরা জাহাজ মালিকেরা সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। কারণ, ঝুঁকি নিয়ে জাহাজ চলাচল করা উচিত হবে না।’

প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে সূর্যাস্ত

স্কোয়াব সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর জানান, সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে টেকনাফের পরিবর্তে এবার কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করবে। এর মধ্যে ৬ অক্টোবর থেকে কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছটার বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে ছাড়া হবে ৬৩২ জন ধারণক্ষমতার জাহাজ এমভি কর্ণফুলী। একই ঘাটে ১৫ অক্টোবর থেকে ছাড়বে ৫৫০ জন ধারণক্ষমতার এমভি বারো আউলিয়া। প্রতিদিন সকাল সাতটার দিকে জাহাজ দুটি ঘাট থেকে ছেড়ে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে জাহাজ সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পৌঁছাবে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে। অন্যদিকে আগামী ৩ নভেম্বর থেকে ১ হাজার ৫০০ জন ধারণক্ষমতার অত্যাধুনিক জাহাজ বে-ওয়ান ছাড়বে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সৈকতের ১৫ নম্বর ওয়াটার টার্মিনাল থেকে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে জাহাজটি চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিয়ে সেন্ট মার্টিনে পৌঁছাবে পরের দিন সকাল আটটার দিকে।

স্থানীয় প্রশাসন ও জাহাজ মালিকেরা জানান, প্রতিবছর অন্তত ১৫ লাখ পর্যটক টেকনাফ থেকে জাহাজে করে ভ্রমণে যান ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনে। আবহাওয়া পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রতিবছর অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত জাহাজ চলাচল করে। তবে এবার জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় টেকনাফ হয়ে জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিন এলাকায় পর্যটননির্ভর অনেক ব্যক্তি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া কক্সবাজার থেকে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে চলাচলকারী যানবাহনের মালিকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে মিয়ানমারের সীমান্ত পরিস্থিতি উন্নতি হলে আবার জাহাজ চলাচল শুরু হবে বলে আশাবাদী জাহাজমালিকেরা।

স্থানীয় সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষায় পর্যটকের সংখ্যা কমিয়ে নিয়ে আসার পরিকল্পনার কথা বলে আসছিলেন সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। টেকনাফে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় সে উদ্দেশ্য কিছুটা সফল হবে।