ঐতিহ্যের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বখশি হামিদ মসজিদ

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বখশি হামিদ জামে মসজিদ
ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের ইলশা গ্রাম। বাংলাদেশের আর দশটি গ্রামেই মতোই সাধারণ। কিন্তু এটি অনন্য হয়ে উঠেছে একটি বিশেষ কারণে। গ্রামটি ধরে রেখেছে দূর অতীতের একটি স্মৃতি, যেটি গৌরবের আর ঐতিহ্যের। আজ থেকে ৪৫৪ বছর আগে এ গ্রামেই ইট, পাথর ও সুরকি দিয়ে নির্মিত হয়েছিল একটি নান্দনিক মসজিদ। এটির নাম বখশি হামিদ জামে মসজিদ। মোগল স্থাপত্যরীতির সুন্দর এ কাঠামো আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতীক। শত শত বছর ধরে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে আসছেন। স্থাপত্য নিদর্শনটি অবশ্য নির্মাণকাল থেকে কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে।

চট্টগ্রাম শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী একটি নির্জন গ্রাম ইলশা। এ গ্রাম থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে সমুদ্রসৈকতের খানখানাবাদ ও বাহারছড়া পয়েন্ট। ২৬ আগস্ট বাঁশখালীর প্রধান সড়কের গুনাগরি খাসমহল থেকে পশ্চিম দিকে জলকদর খাল পেরিয়ে বশির উল্লাহ মিয়ার বাজার ও মোশাররফ আলী মিয়ার বাজার পার হয়ে সংকীর্ণ-ভাঙাচোরা রাস্তা পেরিয়ে যখন মসজিদের কাছাকাছি পৌঁছালাম, তখন ভাদ্রের উত্তপ্ত দিনের সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। মসজিদের চৌহদ্দিতে পৌঁছেই প্রথম চোখে পড়ল শানবাঁধানো ঘাটের বিশাল দিঘি।

দিঘির পাড় ঘেঁষে মাদ্রাসা ও হেফজখানা। এতিমখানার জন্য নির্মিত অবকাঠামো পেরিয়ে চোখে পড়ে খোলা আঙিনা। সে আঙিনার পশ্চিম পাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ৩৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২৩ ফুট প্রস্থের মসজিদটি। পাথরের গাঁথুনিতে নির্মিত মূল প্রবেশতোরণটিতে রয়েছে ফুলের কারুকাজ। দুই পাশে আরও দুটি প্রবেশপথ (এখন বন্ধ) অর্ধগম্বুজের মতো। এগুলোও নকশা করা। ভেতরে মূল কাঠামোয় কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে। মূল মিম্বরটির অনেক অংশ এখন নেই। বর্তমানে মিম্বরের যেটুকু চোখে পড়ে, তার ভেতর ও বাইরে চোখে পড়ে নকশার কারুকাজ। মিম্বরের দুদিকে গম্বুজ আকৃতির কুলঙ্গি। উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকের দেয়ালে মনকাড়া নকশায় গম্বুজের মতো কুলঙ্গি। বিজলিবিহীন দিনগুলোয় হয়তো এসব কুলঙ্গিতেই বাতি জ্বলত।

মসজিদের ভেতর থেকে ওপরের দিকে তাকালে বড় একটি গম্বুজ চোখে পড়ে। দুই পাশে আরও দুটি ছোট গম্বুজ। গম্বুজগুলোর চূড়া পদ্মফুলের মতো। বড় গম্বুজটির ভেতরে লতাপাতার অলংকরণ।

মূল প্রবেশপথের ওপর আরবিতে লেখা একটি শিলালিপি আছে। মসজিদটি সম্রাট সুলাইমান কররানির আমলে নির্মিত বলে শিলালিপিতে উল্লেখ আছে। স্থাপনার কাল ৯ রমজান ৯৭৫ হিজরি, ৯ মার্চ ১৫৬৮ খ্রিষ্টাব্দ।

শিলালিপিতে প্রতিষ্ঠাতার নাম সুলাইমান কররানির কথা উল্লেখ থাকলেও মসজিদের নাম বখশি হামিদ, তা নিয়ে একটা রহস্য রয়েছে। সে সম্পর্কে নানা উপকথা প্রচলিত রয়েছে। মসজিদকে ঘিরে গড়ে ওঠা মাদ্রাসা, হেফজখানা, এতিমখানাসহ বিশাল কমপ্লেক্সের পরিচালক মাওলানা আবদুল মজিদ বলেন, শিলালিপিতে উল্লেখ আছে সুলাইমান কররানির কথা। কিন্তু এটি সবার কাছে বখশি হামিদ মসজিদ নামে পরিচিত। বখশি হামিদের পুরো নাম ছিল আবদুল হামিদ বখশি। বখশি মানে কালেক্টর। মূলত, তিনি ছিলেন করগ্রহীতা। তিনিই ছিলেন এ অঞ্চলের প্রশাসক। বখশি হামিদের প্রচেষ্টায় অঞ্চলের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নয়ন হয়। তিনি এ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা।

কেউ কেউ বলেন আবার অন্য কথা, সুলাইমান কররানি একজন জ্ঞানী সুফি–দরবেশ ছিলেন। তিনি গৌড় থেকে এসেছিলেন। এ এলাকায় তাঁর অনেক ভক্ত ছিল। শ্রদ্ধাভরে তাঁকে সবাই সুলতান বলে ডাকতেন। বখশি হামিদ হয়তো তাঁকে সম্মান জানানোর জন্যই তাঁর নাম দিয়েছেন।

১৯৭০ সালে তৎকালীন সরকার বখশি মসজিদকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। প্রত্ন বিভাগের তালিকায় তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটিকে মুঘল স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বখশি মসজিদের প্রতিষ্ঠাকাল ও এর নির্মাতা নিয়ে নানা রকম গল্প রয়েছে। সেসব গল্পকে ছাপিয়ে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে স্থাপনাটি নিজস্ব মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। আর সুন্দর এ স্থাপনার সামনে এসে দাঁড়ালে মনে হয়, আমি যেন হারিয়ে যাওয়া অতীতে ফিরে গিয়েছি। মনে হয়, আমরা এক গৌরবময় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। এটি এমন একটি স্থান, যেখানে শত শত বছর ধরে প্রতিদিন মানুষ দিনে পাঁচবার আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে আসেন।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে বখশি মসজিদে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন। শুধু প্রার্থনার পবিত্র জায়গা নয়, এটি একটি পর্যটনস্থানও। এখান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগর। বাঁশখালীর বাহারছড়ার সৈকতে মানুষের তেমন ভিড় থাকে না। প্রকৃতির খোলা হাওয়ায় বিস্তৃত সৈকত যেন বুক পেতে আছে পর্যটকদের আশায়। মসজিদটি দেখার পর পর্যটকেরা বাহারছড়া সৈকতে ঘুরে যেতে পারেন। কিন্তু এর জন্য যোগাযোগব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন দরকার। সরু, সংকীর্ণ, ভাঙাচোরা ও গর্তবহুল সড়ক গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই পর্যটকদের যদি ক্লান্ত করে দেয়, তবে সে এলাকা যতই ঐতিহ্যবাহী ও গৌরবময় হোক না কেন, সেটি কখনো পর্যটনবান্ধব হতে পারে না।