রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন ও হয়রানির অভিযোগ এলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি হচ্ছে না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি না হওয়ায় ছাত্রলীগের নির্যাতন বেড়েই চলেছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলা আছে।
করোনার পর ২০২১ সালের শেষে আবাসিক হল খুললে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মারধর, ভয়ভীতি প্রদর্শন, আসন-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অভিযোগের ঘটনা সামনে আসতে শুরু করে। ২০২২ সালেও যা অব্যাহত থাকে। দুই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে ৩০টির বেশি। অন্তত ২৫টি ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। ১৩টি ঘটনা ঘিরে তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ৮টির বেশি। তবে কোনো ঘটনায় ছাত্রলীগের কাউকে শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলা ভঙ্গ বা অপরাধের শাস্তির বিষয়টি নির্ধারিত হয় শৃঙ্খলা কমিটির সভায়। প্রতি ছয় মাসে অন্তত একবার এই কমিটির সভা হওয়ার কথা। তবে গত ১৪ বছরে সভা হয়েছে মাত্র দুটি।
চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে অন্তত ১৫টি অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় আবাসিক হলের প্রাধ্যক্ষ ও প্রক্টর দপ্তরে অন্তত ১০টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এগুলোর কোনোটি তদন্তাধীন, কোনোটি তদন্ত শেষে শৃঙ্খলা কমিটিতে যাওয়ার অপেক্ষায়, আবার কোনোটি মৌখিক অভিযোগের পর মীমাংসা হয়ে গেছে।
সবশেষ গত শনিবার বিকেলে রাজশাহী সিটি নির্বাচনে প্রচার মিছিলের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের দুই শিক্ষার্থীর বিছানাপত্র নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের দুই নেতার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম আলী ও সহসভাপতি মাজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
লিখিত অভিযোগের বিষয়ে ভুক্তভোগী জোনায়েদ আহমদ ও জোবায়েদ হোসেন বলেন, এ ধরনের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে, সে জন্য হল প্রাধ্যক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন। তাঁরা কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেতে চান না।
হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বিছানাপত্র নামিয়ে দেওয়ায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা তাঁদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে হল প্রশাসন জরুরি সভা ডাকে। সভায় হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম আলী ভেতরে ঢুকে আবাসিক শিক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণ করেন। নাঈমের বিরুদ্ধে আগেও অনেক অভিযোগ আছে। তাঁর বিরুদ্ধে অতীতের সব অভিযোগ পর্যালোচনা করে হল প্রশাসন তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী বহিষ্কারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রক্টর দপ্তর ও বিভিন্ন হল সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ মাসে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অন্তত ১৫টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর কোনোটি লিখিত, কোনোটি মৌখিক। কিছু অভিযোগ মীমাংসা হয়ে গেছে। কিছু অভিযোগের তদন্ত চলছে। অন্তত তিনটি অভিযোগের তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিটি। ১৯ জানুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখদুম হলে চাঁদার জন্য এক শিক্ষার্থীকে মারধর, ২৬ জানুয়ারি রাতে নবাব আবদুল লতিফ হলে তিন ছাত্রকে শাসিয়ে বের করে দেওয়া চেষ্টা, ১ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদ শামসুজ্জোহা হলে দুই শিক্ষার্থীর বিছানাপত্র ফেলে দেয় ছাত্রলীগ।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী কৃষ্ণ রায়কে মারধর ও ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে হত্যার হুমকি, ২৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের তিন নেতার বিরুদ্ধে এক ছাত্রীকে হত্যার হুমকি ও তাঁর বন্ধুদের মারধরের অভিযোগ পাওয়া যায়। একই দিন নবাব আবদুল লতিফ হলের সিলগালা করা ১১০ নম্বর কক্ষের তালা ভেঙে দখলে নেওয়া, ২৮ ফেব্রুয়ারি মন্নুজান হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি আতিফা হকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রীকে বন্ধুদের দিয়ে ‘ধর্ষণের’ হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
১৭ মার্চ ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী সাফায়েত হোসেনকে মারধর, ২০ মার্চ মাদার বখশ হলের এক আবাসিক ছাত্রকে কক্ষ ছাড়তে সাত দিনের আলটিমেটাম, বরাদ্দ পেয়েও ২১ মার্চ ছাত্রলীগের বাধায় জিয়াউর রহমান হলে নিজের আসনে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর উঠতে না পারা, ২৫ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ খাবার স্থগিতের প্রতিবাদে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল ফটক তালাবদ্ধ রাখা, ২৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক মো. মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে হল থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
২২ মে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের দুই সদস্যকে মারধর, ২৬ মে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে তিন দফা মারামারির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের এক পক্ষ শহীদ শামসুজ্জোহা হলের বিভিন্ন ব্লকে দেশি অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। চলতি শিক্ষাবর্ষে স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩০ মে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক হাসিবুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১ জুন নাট্যকলা বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে হুমকি ও মারধরের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।
সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গ বা অপরাধের অভিযোগ উঠলে তাঁকে সাময়িক বহিষ্কার করতে পারেন উপাচার্য। এরপর তদন্ত কমিটির সুপারিশ সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটি সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীকে আজীবন বা বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার কিংবা অন্য কোনো শাস্তি দিতে পারে। প্রতি ছয় মাসে অন্তত একবার কমিটির সভা হওয়ার কথা। তবে গত ১৪ বছরে ২০১১ ও ২০১৬ সালে শৃঙ্খলা কমিটির মাত্র দুটি সভা হয়েছে।
শৃঙ্খলা কমিটিতে ওঠার জন্য ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালে তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা পড়েছে অন্তত ১৫টি। চলতি বছর প্রথম শৃঙ্খলা কমিটির সভা ডাকা হয় ২০ ফেব্রুয়ারি। পরে সভাটি স্থগিত করা হয়। এরপর ৭ জুন স্থগিত হওয়া সভাটি ডাকা হয়। কিন্তু এবারও সভাটি হচ্ছে না বলে জানা গেছে। সভায় ১৫টি অভিযোগ ওঠার কথা ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক থেকে দেড় বছর আগের অপরাধের শাস্তি না দেওয়া প্রশাসনের শুধু অবহেলাই নয়; অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। আসলে ব্যবস্থা নেওয়ার নৈতিক সাহসই নেই তাঁদের।’ অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, ‘প্রশাসন সব সময়ই চায় অভিযোগগুলো ধামাচাপা পড়ুক। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার মতো দৃঢ় মনোবল প্রশাসনের নেই। শাস্তি না হওয়ায় বারবার নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।’
এ বিষয়ে কথা বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও শৃঙ্খলা কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আসাবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ১৫টির মতো অভিযোগ শৃঙ্খলা কমিটির সভায় ওঠার কথা ছিল। সভা হওয়ার কথা ছিল ৭ জুন। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতিতে বেশ কয়েকজন জড়িত আছেন। তাঁদের বিষয়টিও শৃঙ্খলা কমিটির সভায় ওঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৭ জুন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য ঈদের পর সভাটি হবে।