কুড়িগ্রাম-চিলমারী মহাসড়কঘেঁষা বালাবাড়ি রেলস্টেশনের পাশে বাঁশঝাড়ের নিচে একটি পাকা স্থাপনা। স্থাপনার বাইরের দেয়ালে লেখা ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে সম্মুখসমরের স্মৃতিস্তম্ভ’। কেউ দেখিয়ে না দিলে বোঝার উপায় নেই, এই বাঁশঝাড়ের নিচে পাকা স্থাপনা ঘিরে রয়েছে শহীদদের গণকবর ও বধ্যভূমি। চিলমারী উপজেলার থানাহাট ইউনিয়নে এই বালাবাড়ি বধ্যভূমি অবস্থিত।
স্বাধীনতাযুদ্ধের সম্মুখসমরে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে প্রাণ হারানো বীর শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে। বালাবাড়ি বধ্যভূমির মতো একই চিত্র উলিপুর উপজেলার দাগারকুটি বধ্যভূমি, ডাকবাংলো গণকবর, রাজারহাট উপজেলার ঠাটমারী বধ্যভূমি ও নাগেশ্বরী উপজেলার চর বেরুবাড়ি বধ্যভূমির।
গত সোমবার উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, দাগারকুটি বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভটি অবহেলা ও অযত্নে পড়ে আছে। পাশের বাড়ির শিশুদের শীতকালীন কিছু পোশাক সেখানে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। রংপুরে যতগুলো গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, হাতিয়া গণহত্যা এর মধ্যে অন্যতম। সেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৬৯৭ জন মানুষকে হত্যা করার পাশাপাশি গাবুরজান, বাগুয়া অনন্তপুর, রামখানা, নীলকণ্ঠ, কলাতিপাড়া, শ্যামপুর, কামারটারী ও দাগারকুটি গ্রামে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও হাতিয়ার দাগারকুটি গ্রামে সংঘটিত গণহত্যা রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন হয় না ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি।
গতকাল কুড়িগ্রাম-রংপুর সড়কের পাশে ঠাটমারী সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ঠাটমারী বধ্যভূমি তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। ভেতরে দুটি ছাগল ঘাস খাচ্ছে। তালাবদ্ধ থাকলেও সহজে প্রাচীর টপকে ভেতরে যাওয়ার সহজ পথ পাওয়া গেল। স্থানীয় কয়েকজন জানান, এখানে প্রশাসনের কেউ আসেন না। সেই সুযোগে দিনে ও রাতে বসে নেশার আসর। ১৯৭১ সালে এখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী ও পুরুষ ধরে এনে এখানে নির্যাতন করে হত্যা করত। পরে রেললাইনের পাশে গর্ত করে পুঁতে রাখত। রাজারহাট ঠাটমারী সেতুর কাছে ওই কোয়ার্টার ক্যাম্প ঘিরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। লড়াইয়ে শহীদ হন ছয়জন মুক্তিসেনা। শহীদদের স্মরণে এ স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিফলক। কিন্তু বছরের অধিকাংশ সময় অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে এই স্মৃতিফলক।
এলাকাবাসী মুক্তিযুদ্ধের শোক ও গৌরবের সাক্ষী বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের পাশাপাশি যেসব জায়গায় বধ্যভূমি নির্মাণ হয়নি, সেসব জায়গায় বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ–গবেষক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত এস এম আব্রাহাম লিংকন জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় কুড়িগ্রাম জেলার প্রায় সব উপজেলায় কমবেশি সম্মুখযুদ্ধ হয়েছিল। এই জেলায় মোট বধ্যভূমির সংখ্যা ৮১। এর মধ্যে মাত্র ১৫টি বধ্যভূমি ও গণকবরে স্থানীয় ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। অধিকাংশ বধ্যভূমি ও গণকবর সংরক্ষণ না করায় এবং নদীভাঙনের ফলে হারিয়ে গেছে। আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব বধ্যভূমি ও গণকবর এলাকা সংরক্ষণ এবং শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা প্রয়োজন।
চিলমারী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান সরকার বলেন, স্বাধীনতার এত বছর পরও কুড়িগ্রামের অর্ধশতাধিক বধ্যভূমি ও গণকবর এখনো অবহেলা ও অযত্নে রয়েছে। এটা দুঃখজনক। যেসব স্থানে বধ্যভূমি ও গণকবর নেই, সেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে বধ্যভূমির স্বীকৃতি দেওয়া হলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার আত্মা শান্তি পাবে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, জেলায় যতগুলো গণকবর ও বধ্যভূমি রয়েছে, সেগুলো সংরক্ষণের জন্য একটি কমিটি করা হবে। কমিটির উদ্যোগে জেলার মোট বধ্যভূমির তালিকা তৈরি করে সেগুলোয় বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া যেসব বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে, সেগুলোর যথাযথ মর্যাদা যাতে রক্ষা হয়, সে বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া হবে।