২৮ বছর ধরে এক টাকায় পেঁয়াজু বিক্রি

পেঁয়াজু বিক্রি করে চলে আবুল কাশেমের সংসার। ৪ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টার দিকে দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী ২ নম্বর কাটলা ইউনিয়নের কাটলাবাজারে
ছবি: প্রথম আলো

সীমান্তের ব্যস্ততম বাজারে দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে কুড়মুড় করে পেঁয়াজু খাচ্ছিলেন ৬৮ বছর বয়সী ঠিনু মুরমু। মুহূর্তেই ১০টি পেঁয়াজু খেলেন। বাড়ি থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে আবুল কাশেমের (৫২) দোকানের এক টাকা দামের পেঁয়াজু খেতে এসেছেন। প্রায় তিন দশক ধরে দোকানটির পেঁয়াজুর নিয়মিত ক্রেতা ঠিনু মুরমু। দোকানে আড্ডা শেষে বাড়িতে ফেরার সময় নাতি-নাতনিদের জন্য নিয়ে যান সেই পেঁয়াজু।

৪ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টার দিকে দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী ২ নম্বর কাটলা ইউনিয়নের কাটলাবাজারে পেঁয়াজুর দোকানে ঠিনু মুরমুর সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। কাটলা ইউনিয়নের অভিরামপুর (মাটাল) গ্রামের বাসিন্দা ঠিনু মুরমু বলেন, ‘এ্যাটকার (এখানকার) পেঁয়াজু অনেক ভালো। কাশেমের দোকানটার ওপর মোর এ্যাকটা মায়া পড়ে গেইছে।’

বাজারটির কেন্দ্রবিন্দু কাটলাহাট জামে মসজিদের প্রধান ফটকের সামনের গলিতেই আবুল কাশেমের পেঁয়াজুর দোকান। ২৮ বছর ধরে তিনি এক টাকায় একটি করে পেঁয়াজু বিক্রি করে আসছেন। দূরদূরান্ত থেকে কেনাকাটা ও ঘুরতে আসা লোকজন কাশেমের দোকানের গরম-গরম পেঁয়াজু খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। আবার বাড়ি ফেরার পথে প্রিয়জনের জন্য নিয়ে যান।

এ্যাটকার (এখানকার) পেঁয়াজু অনেক ভালো। কাশেমের দোকানটার ওপর মোর এ্যাকটা মায়া পড়ে গেইছে।
ঠিনু মুরমু, পেঁয়াজু ক্রেতা

পেঁয়াজু বিক্রেতা আবুল কাশেমের বাড়ি কাটলা ইউনিয়নের মাধুপুর গ্রামে। তাঁর বাবা ওয়াজেদ আলীর অভাবের সংসারে কিশোর বয়স থেকেই কাশেমকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। জীবিকার তাগিদে প্রায় এক যুগ কাটলা বাজারে কাজী হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে কাজ করেছেন। সেখানে কাজ করার সময়ই তিনি শিখে ফেলেন মুখরোচক পেঁয়াজু তৈরি। ১৯৯৫ সালে রেস্তোরাঁটি বন্ধ হয়ে যায়। একই বছর বন্ধ হওয়া রেস্তোরাঁটির পাশে পেঁয়াজুর দোকান দেন আবুল কাশেম। সেই সময় প্রতিটি পেঁয়াজু এক টাকায় বিক্রি শুরু করেন তিনি। ২৮ বছর পেরিয়ে গেছে, তিনি এখনো এক টাকাতেই পেঁয়াজু বিক্রি করছেন।

প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা বা সাতটা পর্যন্ত আবুল কাশেমের দোকান খোলা থাকে। এ সময়ের মধ্যে তাঁর দোকানে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ পেঁয়াজু বিক্রি হয়ে যায়। সোম ও শুক্রবার সাপ্তাহিক হাটবারে দোকানে পেঁয়াজু বেশি বিক্রি হয়। পেঁয়াজুতে কম লাভ করে বেশি পরিমাণে বিক্রি করেন, এতে পুষিয়ে যায় বলে জানালেন তিনি।

২৮ বছর ধরে প্রতিটি পেঁয়াজু এক টাকায় বিক্রি করছেন আবুল কাশেম। ৪ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টার দিকে দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী ২ নম্বর কাটলা ইউনিয়নের কাটলাবাজারে

পেঁয়াজুর দোকানটির সামনেই মমিনুর রশিদের ওষুধের দোকান। মমিনুর রশিদ বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই কাশেম ভাইয়ের দোকানে এক টাকা দামের পেঁয়াজু খেয়ে আসছি। আমার দোকানে লোকজন এলে তাঁদের কাশেম ভাইয়ের দোকানের পেঁয়াজু ও চা খাওয়াই। সব পণ্যের ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে ভালো মানের পেঁয়াজুর এত কম দাম শুনে সবাই চমকে ওঠেন। সময়ের পরিবর্তন হলেও তাঁর পেঁয়াজুর দাম ও মান আগের মতোই আছে। বাজারে তিনি একজন ব্যতিক্রমী দোকানদার।’

পেঁয়াজু বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়েই চলছে আবুল কাশেম ও বছিরন বেগম দম্পতির সংসার। লাভের টাকায় তিন মেয়ের পড়ালেখা ও বিয়ের খরচ জুগিয়েছেন। সেই সঙ্গে গ্রামে প্রায় দেড় বিঘা ধানি জমি কিনেছেন। আর দুই বিঘার মতো ধানি জমি নিয়েছেন বন্ধক। গ্রামের মাটির বাড়ি ভেঙে ইট-সিমেন্টের বাড়ি তৈরি করেছেন।

নিজের হাতে বানানো পেঁয়াজুর স্বাদ ও ঘ্রাণ ঠিক রাখতে পেঁয়াজু তৈরিতে খেসারি ডাল, গমের আটা ও ময়দার মিশ্রণ, রসুন, আদা, কাঁচা মরিচ, জিরা, ধনিয়া ও কালিজিরা ব্যবহার করেন আবুল কাশেম। পাঁচ বছর আগে কাঠখড়ি দিয়ে চুলার আগুনে পেঁয়াজু ভাজলেও চুলার ধোঁয়ায় পাশের দোকানদার ও ক্রেতাদের অসুবিধার কথা চিন্তা করে এখন তিনি দোকানে গ্যাসের চুলা ব্যবহার করেন। এতে খরচ বাড়লে পুষিয়ে নিতে পেঁয়াজু বিক্রির পাশাপাশি লাল চা বিক্রি করেন। প্রতি কাপ চা বিক্রি করেন পাঁচ টাকায়। আবুল কাশেমের ভাষ্য, পেঁয়াজু খেতে আসা অধিকাংশ ক্রেতাই চায়ে চুমুক দিয়ে তারপরেই দোকান থেকে ওঠেন।

বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও তাঁর পেঁয়াজুর দাম কেন বাড়েনি, এর জবাবে আবুল কাশেম বলেন, ক্রেতাদের প্রতি ভালো লাগা ও শ্রদ্ধাবোধ থেকেই পেঁয়াজুর দাম বাড়াননি। অল্প লাভ করে বেশি পরিমাণে বিক্রি করে পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। বাজারে রাস্তার পাশে তাঁর দোকানে এসে একেকজন ১০ থেকে ১৫টি করে পেঁয়াজু খান, আবার প্যাকেটে করে বাড়িতে ছেলেমেয়েদের জন্য নিয়েও যান। একজন ক্ষুদ্র দোকানদারের জন্য এটি তো পরম পাওয়া!