পড়ন্ত বিকেল। ক্ষীণ ব্রহ্মপুত্রের জলে সূর্যের আলো চিকচিক করছে। নদীর পাড়জুড়ে বালুর স্তূপ করে রাখা। কর্কশিট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে একটি দৈত্যাকৃতির অবয়ব, যার পাশেই লেখা ‘রাক্ষস খেলো সব, আমাদের কলরব’। ব্রহ্মপুত্র নদের ‘স্মরণসভা’র মঞ্চ ছিল এমনটি। ব্রহ্মপুত্র নদ খনন নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ তুলে প্রতিবাদী এই কর্মসূচির আয়োজন করে সুন্দর শূন্য কিলোমিটার নামের একটি সংগঠন।
আজ শুক্রবার বিকেল পৌনে পাঁচটায় ময়মনসিংহ নগরের কাচারিঘাট এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে এ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। পানি কমতে থাকা ব্রহ্মপুত্র নদকে ‘মৃত’ দাবি করে নদের স্মরণসভা আয়োজনের শুরুতেই দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এরপর উপস্থিত সবার মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। পরে শুরু হয় প্রতিবাদী গান।
মঞ্চের চারপাশে লেখা ছিল প্রতিবাদী নানা স্লোগান। ‘পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সীমানা নির্ধারণ চাই’, ‘নদী দখল, চর দখল রুখে দাও’, ‘নদী কারও একার না, নদী মরলে আমরাও মরি’, ‘ড্রেনেজে ও খননের হিসাব চাই’, ‘গাছ খাও, মাছ খাও, নদী খাও কেন’, ‘পাড় দখল রুখে দাও’, ‘নদী এক জীবন্ত সত্তা’, ‘আমাকে দাও স্রোতের জীবন’, ‘সব বাঁধ ভেঙে দাও’। আয়োজনে মূল উদ্যোক্তা ছিলেন শামীম আশরাফ, কবি মামুন রনি, সাঈদ ইসলাম ও মমিনুর রহমান (প্লাবন)।
সুন্দর শূন্য কিলোমিটার নামের সংগঠনের সমন্বয়ক শামীম আশরাফ বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্রকে খননের নামে মেরে ফেলা হলো। পানি খেয়ে ফেলা হলো, বালু খেয়ে ফেলা হলো, হাজার হাজার কোটি টাকা খেয়ে ফেলা হলো। কে খেল, কতটুকু খেল, কীভাবে খেল-আমরা এর জবাব চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্র মরেই গেছে আমরা ধরে নিয়েছি, তার স্মরণসভা করার জন্য আমরা এসেছি। সুরে সুরে, গানে গানে প্রতিবাদ করব। কেন ব্রহ্মপুত্রকে মারা হলো, কেন পানি খাওয়া, বালু, মাছ খাওয়া হলো। তবে এই স্মরণসভা আসলে ব্রহ্মপুত্রকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। আমরা গানে গানে আর্তনাদ করব, চিৎকার করব, আমাদের ব্রহ্মপুত্রকে পানি দাও, স্রোত দাও, কৃষকের সুবিধা দাও, মাঝিদের ভাত দাও। শুধু ব্রহ্মপুত্র নয়, সারা দেশের নদ-নদী ও খালবিলগুলো যেন দখলমুক্ত করা হয়, এর জন্যই আজকের আয়োজন। আমরা দাবি জানাই, খননের নামে কারা লুটপাট করেছে, ব্রহ্মপুত্রকে খাল বানাল কারা, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। ব্রহ্মপুত্রকে পুরোনো সীমানা ফিরিয়ে দিতে হবে, এই আমাদের আহ্বান। আমরা চাই ব্রহ্মপুত্র সচল থাকুক।’
গানে গানে শিল্পীরা প্রতিবাদী সুরের ঝংকার তুলে। চলে প্রতিবাদী কবিতাও। হীরক সিঙ্গার, মিজান বাউলা, অনিরুদ্ধ শুভদের গানে মুখর হয়ে উঠে ছুটির দিনে ব্রহ্মপুত্রপাড়ের বিকেল।
ব্রহ্মপুত্রকে পুরোনো অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে সীমানা নির্ধারণ প্রয়োজন জানিয়ে কবি সাঈদ ইসলাম বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্রে যেন তার স্রোত ফিরে আসে। বলা হয়েছিল, গত বছরই এই ব্রহ্মপুত্রে জাহাজ চলবে। কিন্তু আজ এই নদ শুকিয়ে যাচ্ছে, চর পড়ছে। আসলে খননের নামে টাকাগুলো কোথায় যাচ্ছে, কারা লোপাট করছে, তার বিরুদ্ধে কথা বলছি।’ তিনি আরও বলেন, নদী হচ্ছে সভ্যতার কেন্দ্র। এই খননকাজ কীভাবে হচ্ছে, জনগণের কাছে যেন তার জবাব দেওয়া হয়।
সংগীতশিল্পী হীরক সিঙ্গার বলেন, ‘আমরা সুরে সুরে প্রতিবাদী গান দিয়ে আর্তনাদ পৌঁছে দিতে চাই, যারা নদটিকে হত্যা করেছে, তারা যেন শাস্তি পায়। নদটিকে যেন পুরোনো রূপে ফেরত দেওয়া হয়।’
চলতি বছরের জুনে ব্রহ্মপুত্র খনন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নির্বাহী প্রকৌশলী মহসিন মিয়া শুক্রবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত মোট ৩৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ পর্যন্ত ৭০০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। বর্তমানে বর্ষার কারণে খননের কাজ বন্ধ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘খননকাজ শুরুর করার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। প্রকল্পের কাজের শুরু থেকেই সমস্যা ছিল জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদের উৎসমুখে খনন করতে না পারা। ৩৬টি ড্রেজার আমরা সেখানে নিলেও এলাকাবাসীর বাধার কারণে খনন করতে পারছি না। এলাকার লোকজন বিভিন্নভাবে সমস্যা করছেন। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, উৎসমুখ খনন করতে না পারলে কোনো সুফল আসবে না। বছরের ৭ মাস যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের সংযোগ বন্ধ থাকে। এ কারণে কোনো পানি থাকে না।’
মহসিন মিয়া দাবি করেন, ‘খনন নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ভিত্তিহীন। এ কথা বলতে হয়, এ জন্য বলা। আমরা পুরোদমে কাজ চালুর চেষ্টা করছি। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বা অন্য কোনো জায়গা থেকেও সাপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না।’
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, তারা ২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের খননকাজ করছে। গাইবান্ধা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ-এই পাঁচ জেলায় নদের ২২৭ কিলোমিটার অংশ খনন করার কথা। কোনো কোনো এলাকায় খনন শেষ, কোনো কোনো এলাকায় কাজ চলছে, কোনো কোনো এলাকায় কাজ শুরু হয়নি। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া খনন প্রকল্পটি চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পে কাজের প্রথম দুই বছর ড্রেজিং এবং পরবর্তী তিন বছর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হওয়ার কথা ছিল। যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থল জামালপুরের কুলকান্দি থেকে কিশোরগঞ্জের টোক পর্যন্ত নাব্যতা ফিরিয়ে এনে সারা বছর যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী নৌযান চলাচল নিশ্চিত করা, যেন শুষ্ক মৌসুমেও ৯০ মিটার প্রস্থে ৮ থেকে ১০ ফুট গভীর পানি থাকে, প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল এমনটি।