আঞ্জুয়ারাকে হারিয়ে সন্তান–স্বজনদের আহাজারি

আঞ্জুয়ারার মৃত্যু খবর শুনে কিছুতেই থামছে না মা মাজেদা খাতুনের আহাজারি। বুধবার দুপুরে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার চর নাটিপাড়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে বিক্ষোভরত পোশাকশ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে আঞ্জুয়ারা খাতুনের (৩০) মৃত্যুর খবর শুনে তাঁর মা মাজেদা খাতুন যেন বাক্‌রুদ্ধ। ছোট মেয়ের এমন মৃত্যুতে কিছুতেই থামছে না তাঁর আহাজারি। খবর পেয়ে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন তাঁদের বাড়ি। কেউ দেন সান্ত্বনা, কেউ ফেলেন চোখের পানি।

আঞ্জুয়ারা সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার চরগিরিশ ইউনিয়নের চর নাটিপাড়া গ্রামের মাজেদা খাতুন ও মৃত মন্টু মিয়া দম্পতির মেয়ে। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আঞ্জুয়ারা সবার ছোট। ওই একই ইউনিয়নের সালাল গ্রামে আঞ্জুয়ারার শ্বশুরবাড়ি। তাঁর আরিফ নামে সাত বছরের একটি ছেলে ও জয়া নামে ছয় বছর বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে। কোনাবাড়ীর ইসলাম গার্মেন্টসে সেলাই মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন আঞ্জুয়ারা।

বুধবার দুপুরে আঞ্জুয়ারার বাবার বাড়িতে সরেজমিনে দেখা যায়, তাঁর মা ও স্বজনেরা আহাজারি করছেন। তখনো আঞ্জুয়ারার লাশ বাড়িতে এসে পৌঁছায়নি। আঞ্জুয়ারার শ্বশুরবাড়িতেও একই চিত্র দেখা যায়।

চরগিরিশ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম বলেন, মেয়েটির এমন মৃত্যু খুবই বেদনাদায়ক। তাঁদের ফুটফুটে দুটি সন্তানের ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই অনিশ্চিত। কারণ, মা বেঁচে থেকে দূরে থাকলেও সন্তানের একটা শক্তি থাকে।

আঞ্জুয়ারার স্বামী জামাল মিয়ার ছোট বোন আর্জিনা খাতুন বলেন, কাজের জন্য তাঁর ভাই জামাল ও ভাবি আঞ্জুয়ারা গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে থাকতেন। তাঁদের দুই শিশুসন্তান গ্রামের বাড়িতে দাদির কাছে থেকে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। সম্প্রতি পূজার ছুটিতে দুই সন্তান কোনাবাড়ীতে মা–বাবার সঙ্গেই ছিল। ছুটি শেষে আবার দাদির কাছে গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছে। ঠিক এমন সময়ে ঘটে গেল এই মর্মান্তিক ঘটনা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে নিহত আঞ্জুয়ারার স্বজনদের আহাজারি। বুধবার সকালে

আঞ্জুয়ারার শাশুড়ি নূরজাহান বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিসের নিগা ছোট ছোট পোলাপানগুনা মাও হারাইল? আমরা এই বাচ্চাগরে কান্দাকাটি ক্যামনে থামামু? কিবা কইরা তাদের মায়ের দুঃখু দূর করমু?’

আঞ্জুয়ারার স্বামী জামাল মিয়া মুঠোফোনে আজ বুধবার বিকেলে বলেন, ‘আঞ্জুয়ারা দীর্ঘদিন গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে যমুনা পোশাক কারখানায় কর্মরত ছিল। সম্প্রতি সে ইসলাম গার্মেন্টসে সেলাই মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেছিল। আমি এখানেই একটি ডিজাইন প্রিন্টিং কারখানায় কাজ করি। আঞ্জুয়ারার লাশ এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে। গ্রামের বাড়িতে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।’

পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করে আসছিলেন। মঙ্গলবার মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করে সরকার। কিন্তু এতে শ্রমিকেরা সন্তুষ্ট নন। তাই বুধবার সকাল সাড়ে নয়টার পর থেকে গাজীপুরের কোনাবাড়ী, জরুন, বাইমাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় তাঁরা বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে শ্রমিকেরা বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে কাঠ ও টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন যানবাহন ভাঙচুরের চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এ সময় শ্রমিকেরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছেন। পরে পুলিশ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়।

পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেটের আঘাতে অন্তত ১০ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন। তাঁদের উদ্ধার করে কোনাবাড়ী পপুলার, কোনাবাড়ী ক্লিনিক ও গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকদের বিক্ষোভের খবর পাওয়া যায়, তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শিল্প পুলিশ, থানা-পুলিশের পাশাপাশি বিজিবির সদস্যও মোতায়েন করা হয়েছে।

কোনাবাড়ী এলাকায় বিক্ষোভরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে আঞ্জুয়ারা আহত হন। সকালে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান তিনি।