কক্সবাজার পৌরসভার উত্তর কুতুবদিয়া পাড়ায় একটি বেসরকারি শিখন স্কুলে পড়ছে জলবায়ু উদ্বাস্ত শিশুরা। প্রাত্যহিক সমাবেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে শিক্ষকেরা সচেতন করেন শিক্ষার্থীদের। সম্প্রতি তোলা
কক্সবাজার পৌরসভার উত্তর কুতুবদিয়া পাড়ায় একটি বেসরকারি শিখন স্কুলে পড়ছে জলবায়ু উদ্বাস্ত শিশুরা। প্রাত্যহিক সমাবেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে শিক্ষকেরা সচেতন করেন শিক্ষার্থীদের। সম্প্রতি তোলা

কক্সবাজারের কুতুবদিয়া

পাঠ্যপুস্তকে জলবায়ু অভিঘাতের বিবরণ চায় উপকূলের মানুষ

আগামী বছরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকে জুলাই অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি এবং এ–বিষয়ক প্রবন্ধ ও কবিতা যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এসবের সঙ্গে পাঠ্যপুস্তকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ক্ষতিকর দিক এবং সমস্যা ও সংকট মোকাবিলায় করণীয় বিষয়ে লেখা অন্তর্ভুক্তের চান কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপকূলের মানুষ।

গত ১১, ১২ ও ১৩ নভেম্বর সরেজমিনে কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দা ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলো। তাঁরা এ সময় তাঁরা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিকগুলো পাঠ্যপুস্তকে তুলে ধরার বিষয়ে অভিমত দেন।

উপকূলবাসী জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে পানির উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত ভাঙছে উপকূল। ঘরবাড়ি যেমন বিলীন হয়ে মানুষ নিঃস্ব হচ্ছেন, তেমনি কমছে চাষাবাদের জমি। অতিরিক্ত তাপমাত্রা এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। গরম সহ্য করতে না পেরে হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। বজ্রপাতে প্রাণহানিও বাড়ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলপড়ুয়া কিশোরী মেয়েদের স্বাস্থ্যগত সংকট; মেয়েদের শিক্ষার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাল্যবিবাহ, লিঙ্গবৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে, তাতে জীবিকার উৎস ধ্বংস হচ্ছে। লবণাক্ততার আগ্রাসনে খাবার–সংকটে গরু-ছাগল-মহিষ পালন কমে আসছে। পেশা হারিয়ে এলাকার মানুষ শহরমুখী হচ্ছেন। কিন্তু এসব নিয়ে পাঠ্যপুস্তকে বিশদ আলোচনা নেই।

কুতুবদিয়া বাঁচার আন্দোলনের সভাপতি ও সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আ স ম শাহরিয়ার চৌধুরী বলেন, বিশ্বজুড়ে এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক এবং ঝুঁকি নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। কক্সবাজার উপকূলের ১৫ লাখসহ দেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলার মানুষের জীবন–জীবিকার বিষয়টি মাথায় রেখে হলেও পাঠ্যপুস্তকে এর বিশদ আলোচনা দরকার, যা থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সচেতন এবং সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাবে।

পাঠ্যপুস্তকে যা আছে

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য ষষ্ঠ শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বই’ এ দেখা যায় জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। যদিও বইটিতে নানা বিষয়ে মোট ১২টি অধ্যায় রয়েছে। কুতুবদিয়ার একটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী মারুয়া সাফায়েত জানায়, জলবায়ু কী সে জানে না, পাঠ্যবইতেও নেই।

কুতুবদিয়া এবিসি মডেল কিন্ডারগার্টেনের প্রধান শিক্ষক ওয়াহিদুর রহমান বলেন, সারা দেশে শিক্ষার্থীদের জন্য সম্ভব না হলেও শুধু উপকূলীয় জেলার শিক্ষার্থীদের জন্য জলবায়ু নিয়ে পাঠ্যপুস্তকে বিশদ আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

উপজেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, কুতুবদিয়া উপজেলায় সাক্ষরতার হার ৭৭ শতাংশ। এ উপজেলায় ১টি সরকারি কলেজ, ১টি মহিলা কলেজ, ১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় (বালিকা), ১টি টেকনিক্যাল অ্যান্ড বি এম কলেজ, ১টি ফাজিল মাদ্রাসা, ১টি আলিম মাদ্রাসা, ২টি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৭টি দাখিল মাদ্রাসা, ১টি নিম্ন মাধ্যমিক (বালিকা) বিদ্যালয়, ৫৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৩২টি কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে। শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩৪ হাজার।

সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিষয়ে বিশদ আলোচনা নেই। বইটিতে সাতটি অধ্যায় রয়েছে। বইটির ৩৮ পৃষ্ঠায় মানচিত্রের মাধ্যমে ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল চিহ্নিত করে দেখানো হলেও এর বিস্তারিত বিবরণ নেই। ১৩৫ পৃষ্ঠায় ‘টেকসই উন্নয়ন ও আমাদের ভূমিকা’ অধ্যায়ে প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার, প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব নিয়ে কিছুটা আলোচনা আছে। ১৪৬ পৃষ্ঠায় ‘আমাদের সমুদ্রসম্পদ ব্লু–ইকোনমি’ নিয়ে বিস্তারিত উল্লেখ থাকলেও জলবায়ুর প্রভাব এবং দুর্যোগের বিষয়টি নেই।

নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ এর চতুর্থ অধ্যায়ে বাংলাদেশে ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ু নিয়ে আলোচনা আছে কিছুটা। ৬৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গড় তাপমাত্রা দেশের সর্বত্র বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্ষা মৌসুমে অধিক বৃষ্টি হচ্ছে আবার বর্ষাকাল দেরিতে আসছে। স্বল্প সময়ে অধিক বৃষ্টি, ভারী বর্ষণের ফলে ভূমিধস, বন্যা ও পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেছে। হিরণ পয়েন্ট, চর চংগা ও কক্সবাজারের উচ্চতা প্রতিবছর গড়ে ৪ মিলিমিটার থেকে ৬ মিলিমিটার পর্যন্ত বেড়েছে। পলি জমে বহু নদী হারিয়ে যাচ্ছে। নদীভাঙনে প্রায় ৪ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়ে জীবন–জীবিকার টানে শহরের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সাধারণ কৃষক ও দিনমজুর কাজের আশায় শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। এতে পারিবারিক ভাঙন দেখা দিয়েছে। শিশু বৃদ্ধ ও নারীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়েছে প্রাণিজগতের অনেক প্রাণী, বিলুপ্ত হয়েছে জীববৈচিত্র্য, কমেছে খাদ্য উৎপাদন। এতে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বেড়েছে।

ছাত্র–শিক্ষকেরা যা বলেন

কক্সবাজার মডেল হাইস্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক কে এম রমজান আলী বলেন, পাঠ্যবই দুটোতে এমন কিছু বিষয় আছে, যা বাদ দিয়ে সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, ক্ষতিকর দিক এবং বাঁচার উপায় নিয়ে বিশদ আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করা যেত। তাতে উপকূলের অন্তত কয়েক লাখ শিক্ষার্থী জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ধারণা পেত।

কুতুবদিয়ার কবি জসিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক আবুল কাশেম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলের মেয়ে-শিশুরা। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি মোকাবিলায় তাঁরা মোটেও সচেতন নন, তাঁদের মা-বাবারাও সচেতন না। পরিস্থিতির শিকার হয়ে মেয়েরা স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়, বাল্যবিয়ে বেড়ে চলেছে। লিঙ্গবৈষম্যও প্রকট আকার ধারণ করছে।

কুতুবদিয়া মডেল হাই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আকতার হোসেন বলে, জলবায়ু বিষয়ে পাঠ্যপুস্তকে সংক্ষিপ্ত আলোচনা আছে। কিন্তু তাতে বাস্তবিক চিত্র অনুধাবন করা যায় না। কুতুবদিয়া মডেল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক জহিরুল ইসলাম বলেন, পাঠ্যবইতে জলবায়ু সম্পর্কে যেটুকু আলোচনা আছে, তা ঢাকা কিংবা অন্য জেলার শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট হলেও উপকূলীয় এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট নয়। ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস কিংবা নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলের শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে, শিশুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতে হয় পরিবারকে। পাঠ্যবইতে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা থাকলে শিশুশিক্ষার্থীরা সচেতন হতে পারত।

মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকেও জলবায়ুবিষয়ক শিক্ষা নেই বলে জানান বড়ঘোপ ইসলামিয়া কামিল ডিগ্রি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ নুরুল আলম।

চিকিৎসকেরা জানান, কুতুবদিয়ার মানুষের রক্তচাপ–সংক্রান্ত রোগ বেশি। কারণ, পানিতে লবণাক্ততা ( পিপিটি) বেড়ে গেছে। রক্তচাপের কারণে মহিলাদের গর্ভপাত হয়। উপজেলা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, স্বাস্থ্যগত ইস্যুগুলো প্রাইমারি থেকে আনা যায়। উপকূলীয় এলাকার কিশোরী মেয়েরা তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে দ্রুত বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছায়। তাই পাঠ্যপুস্তকে তাদের স্বাস্থ্যবিষয়ক আলোচনা দরকার।

কুতুবদিয়াকে ক্লাইমেট হটস্পট দাবি করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গত তিন দশকে কুতুবদিয়ার অন্তত ৬০ হাজার মানুষ পেশা হারিয়ে শহরে চলে গেছেন। পাঠ্যপুস্তকে জলবায়ুর ক্ষতিকর দিক এবং উত্তরণের উপায় জানা থাকলে অনেকে জন্মভূমিতে বাঁচার উপায় খুঁজে পেতেন।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন বলেন, পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির বইয়ে কিছু বিষয়ে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নতুন পাঠ্যপুস্তকে জলবায়ু–সংক্রান্ত আলোচনা বড় করা দরকার।