বালু উত্তোলন করায় নদীর তীর রক্ষা বাঁধ ও চর খননের কাজ ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় পদ্মা নদী থেকে একটি চক্র অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে দুই মাস ধরে রাতের বেলা পাঁচটি খননযন্ত্র দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের কাছে একাধিকবার মৌখিকভাবে বিষয়টি জানালেও বালু উত্তোলন বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এদিকে বালু উত্তোলন করার কারণে নড়িয়ায় পদ্মার ভাঙন রোধে নির্মাণ করা নদীর তীর রক্ষা বাঁধ ও চর খননের কাজ ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। নড়িয়ার চরআত্রা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য আবদুর রহিমের নেতৃত্বে এসব বালু উত্তোলন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ অনুযায়ী, পাম্প বা ড্রেজিং বা অন্য কোনো মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এ ছাড়া সেতু, কালভার্ট, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, রেললাইন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ।
পাউবো শরীয়তপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব বলেন, চার-পাঁচ দিন আগে স্থানীয়ভাবে খবর পেয়েছেন বালু উত্তোলনের বিষয়ে, তা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জানানো হয়েছে। আর অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের ফলে স্রোত সরিয়ে নেওয়ার জন্য তৈরি চ্যানেল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর প্রভাব ডান তীর রক্ষা বাঁধেও পড়তে পারে।
নড়িয়া উপজেলা প্রশাসন ও পাউবো সূত্র জানায়, ৩০ বছর ধরে নড়িয়ায় পদ্মার ভাঙন প্রবল ছিল। সর্বশেষ ২০১৮ সালে পদ্মার ভাঙনে সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়। এরপর স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীমের উদ্যোগে নড়িয়ায় পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। ১ হাজার ৪১৭ কোটি টাকার ওই প্রকল্পে ১০ কিলোমিটার নদীর তীর রক্ষা বাঁধ ও ১১ দশমিক ৮ কিলোমিটার চর খনন করা হয়। যার মধ্যে চর খননে ব্যয় করা হয়েছে ৪৭৮ কোটি টাকা। পদ্মা নদীর নড়িয়ার ডান তীরে রক্ষা বাঁধ ও বাঁ তীরে চর খনন করা হয়। ডান তীরের স্রোত বাঁ তীরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ২০০ মিটার থেকে ৭০০ মিটার পর্যন্ত (স্থান ভেদে) প্রশস্ত করে একটি চ্যানেল তৈরি করে পাউবো।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ওই চ্যানেলের চরআত্রা পয়েন্ট ও সাহেবেরচর পয়েন্টে পাঁচটি খননযন্ত্র বসিয়েছেন আবদুর রহিম। ওই খননযন্ত্র দিয়ে প্রতি রাতে ৫০-৬০টি বাল্কহেড (বালু পরিবহনের নৌযান) ভর্তি করে বালু নেওয়া হচ্ছে। ওই বালু শরীয়তপুর ছাড়াও মাদারীপুর, মুন্সিগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয়। প্রতিটি বাল্কহেডে পাঁচ হাজার ঘনফুট থেকে আট হাজার ঘনফুট বালু ভর্তি করা হয়। প্রতি ঘনফুট বালু পাঁচ থেকে আট টাকা দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
এলাকার লোকজন আরও বলেন, সন্ধ্যা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত নড়িয়ার চরআত্রা ও সাহেবেরচর এলাকা থেকে বালু উত্তোলন করা হয়। বালু উত্তোলনের খননযন্ত্র দিনে নড়িয়ার কীর্তিনাশা নদীর মুখে ও চণ্ডীপুর এলাকায় পদ্মা নদীর দক্ষিণ তীরে (ডান তীরে) নোঙর করে রাখা হয়। সন্ধ্যার পর ওই খননযন্ত্রগুলো চরআত্রা ও সাহেবেরচরে নেওয়া হয়।
কর্মরত এক শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, খননযন্ত্রগুলো ভাড়ায় আনা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন কোনো চাপ দিলে খননযন্ত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তা চালু করা হয়। স্থানীয় মানুষ যাতে বাঁধা দিতে না পারেন, তার জন্য রাতের আঁধারে এ কাজ করা হচ্ছে। দুই মাস ধরে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
কেদারপুর ইউপির সাবেক এক সদস্য পদ্মার ভাঙনে সব হারিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘সাহেবেরচরটি এখন পদ্মায়। সেখান থেকে বালুখেকোরা রাতে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছেন। রহিম মেম্বারের নেতৃত্বে বালু লুট করা হলেও বাঁ তীরের একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত। আমরা হয়রানিতে পড়তে পারি, এ ভয়ে কিছু বলতে পারছি না। প্রশাসন জেনেও কিছু বলছে না। কিন্তু বালু উত্তোলন বন্ধ করা না হলে নদীর তীর রক্ষা বাঁধ ঝুঁকিতে পড়বে।’
বালু উত্তোলনের বিষয় জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় আবদুর রহিমের সঙ্গে। তিনি কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি। তিনি ঢাকায় রয়েছেন, এমন জানিয়ে এলাকায় ফিরে যোগাযোগ করবেন বলে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
ইউএনও শংকর চন্দ্র বৈদ্য বলেন, আবদুর রহিম নামের এক ব্যক্তি রাতের আঁধারে পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলন করছেন, তাঁরা কাউকে বালু তোলার অনুমতি দেননি। শিগগিরই সেখানে অভিযান চালানো হবে।