বাঁশের বেড়া ও ত্রিপলের ছাউনির ঝুপড়িতে বসবাস আমির আলী (৭২) ও জমিলা বেগম (৫৮) দম্পতির। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে হেঁটে, নদী পাড়ি দিয়ে এসে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮) মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় তাঁদের। সেখানেই ছয় বছর কাটিয়ে দিলেন তাঁরা।
সংসারে টানাপোড়েন লেগেই আছে, কিন্তু দুজনের প্রেম-ভালোবাসার কমতি নেই। এই বয়সেও কেউ কাউকে রেখে কিছু খান না। নিঃসন্তান এই দম্পতি একজন আরেকজনের জন্য সব সময় ব্যাকুল হয়ে থাকেন।
২৫ আগস্ট ছিল রোহিঙ্গা–ঢলের ছয় বছর পূর্তির দিন। আশ্রয়শিবিরে হাজারো রোহিঙ্গা সমাবেশ করে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া আমির-জমিলা দম্পতি সমাবেশে যোগ দিতে পারেননি। তবে তাঁরাও চান জন্মভূমিতে ফিরতে। কিন্তু রাখাইনের জীবনের কথা মনে হলেই তাঁদের তাড়া করে ফেরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি।
বালুখালী আশ্রয়শিবিরে ৬৭ হাজার রোহিঙ্গার বসতি। কমবেশি সবাই বৃদ্ধ আমির-জামিলা দম্পতির অন্য রকম প্রেম-ভালোবাসার কথা জানে। ২৫ আগস্ট দুপুরে আশ্রয়শিবিরের সি ব্লকের ছোট্ট ঘরে গিয়ে দেখা গেল, স্বামী-স্ত্রী দুজন মেঝেতে বসে দুপুরের খাবার সেরেছেন। জমিলা পানের খিলি বানিয়ে তুলে দিলেন স্বামীর হাতে। আমির আলীও আরেক খিলি পান বানিয়ে তুলে দিলেন স্ত্রীর মুখে।
আমির আলীর বাড়ি রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের উত্তর প্রান্তের নগানচাউং গ্রামে। জমিলার বাড়িও একই গ্রামে। কিশোরী জমিলাকে দেখে ভালো লেগেছিল তরুণ আমির আলীর। পরে দুজনের বিয়ে হয়। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ আসার সময়ের কথা জানাতে চাইলে আমির আলী কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে জমিলার দিকে এক পলক তাকালেন। তারপর আমির আলী বলতে শুরু করলেন, সেই ঘটনা ছিল নরকযন্ত্রণার মতো। সেই ঘটনা মনে পড়লে এখনো চোখে পানি আসে।
স্ত্রীর দিকে ইশারা দিয়ে আমির বলেন, স্ত্রীকে কোলে করে হাঁটতে হয়েছিল অনেকটা পথ। শরীরে শক্তি ছিল না, এক পা অচল, তবু কোলে নিতে হয়েছে। এত শক্তি কোথা থেকে এল জানেন না। মনে হয় ভালোবাসার টান।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন চালায় দেশটির সেনাবাহিনী। সে সময় প্রাণ বাঁচাতে আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয়। তখন রোহিঙ্গা–ঢলের সঙ্গে হাঁটা শুরু করেন আমির-জমিলা দম্পতি। বাড়ি থেকে খালি পায়ে হেঁটে ৪০ কিলোমিটার দূরত্বের মংডুর নাফ নদীর তীরে আসতে এই দম্পতির সময় লেগেছিল সাত দিন, যা অন্যদের হেঁটে আসতে সময় লেগেছিল এক দিন।
এই দম্পতি জানান, এক পায়ে সমস্যা থাকায় আমিরকে হাঁটতে হয়েছিল লাঠির সাহায্যে। তখন তাঁর পিঠে বাঁধা ছিল চাল, শুঁটকি, আলুসহ মালামালের একটি বস্তা। জমিলার মাথা, কাঁধ ও কোমরে ছিল কাপড়ের ব্যাগ, হাঁড়িপাতিল, থালাবাসন ইত্যাদি। কিছুদূর গিয়ে বসে পড়েন দুজন। তাঁদের মনে শঙ্কা জাগে, দেশটির সেনাবাহিনী কিংবা মগ সম্প্রদায়ের কেউ সামনে পড়ে কি না।
শত শত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ হাঁটছিল, জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে তখন কার খবর কে রাখে! সবার গন্তব্য নাফ নদীর তীর। কত দ্রুত নৌকায় ওঠা যায়, কত দ্রুত নাফ নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশ সীমান্তের টেকনাফে পৌঁছা যায়। আবার নৌকা না পেলে সীমান্তে পড়ে থাকতে হয়। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে নৌকায় নাফ নদী পারাপারেও ঝুঁকি ছিল। তখন রোহিঙ্গাবোঝাই অসংখ্য নৌকাডুবির ঘটনায় শত শত রোহিঙ্গা মৃত্যুও হয়েছে। রাখাইনের দুর্গম পথ চলার এই রথে কত বাবা হারিয়েছেন ছেলেমেয়ে, কেউ স্ত্রী, ভাইবোন, এর কোনো হিসাব নেই।
আমির আলীর ভাষ্যে, শরণার্থীজীবনে হাঁটার সেই সাত দিন ছিল নরকযন্ত্রণার মতো। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আট দিনের মাথায় তাঁরা নাফ নদী পেরিয়ে টেকনাফ আসতে পেরেছিলেন। পরে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন বালুখালীর এই আশ্রয়শিবিরে।
ছোট একটি কক্ষে দুজন ছয়টি বছর কাটিয়ে দিলেও বাড়ি ফেরার আকুতি আমির-জমিলা দম্পতির চোখে–মুখে। জমিলা বেগম বলেন, রাখাইনে তাঁদের অভাব ছিল না। ঘরে ছিল গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, চাষাবাদের জায়গাজমি। চলছিল সুখের সংসার। এখানে শরণার্থী হিসেবে তাঁরা চাল, ডাল, তেল, ডিম, শুঁটকিসহ নিত্যপণ্য পাচ্ছেন। কিন্তু মাংস, কাঁচা মাছ, শাকসবজি, ফলমূল খাওয়া হয় না মোটেও। বাজারে গিয়ে এসব কিনে খাওয়ার সামর্থ্যও তাঁদের নেই।
আশ্রয়শিবিরের শিক্ষিত তরুণ ইয়াসির আরাফাত বলেন, আমির-জমিলা দম্পতির বন্ধন তরুণদের কাছে দৃষ্টান্ত। দুজনের কাছ থেকে শেখার আছে অনেক কিছু।
প্রতিবেশী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমির-জমিলা স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছেন। আশ্রয়শিবিরে একটি শৌচাগার ১০ থেকে ১৫টি পরিবারের সদস্যরা ভাগাভাগি করে ব্যবহার করেন। গোসলখানাও একটি। যাঁদের থাকার স্থান শৌচাগার ও গোসলখানা থেকে দূরে, তাঁদের সমস্যা হয় বেশি। নলকূপগুলোয় ঠিকমতো পানি আসে না। দূর থেকে পানি সংগ্রহ করা আরও কষ্টের। তবে আমির-জমিলার এই দুর্ভোগ লাঘব হয় প্রতিবেশীদের সহযোগিতায়। সবাই প্রবীণ এই দম্পতিকে সম্মান করে, বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ায়। এখনো এ দম্পতি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারেন। আমির আলী খালি চোখে তিলাওয়াত করতে পারেন পবিত্র কোরআন।
জমিলার চেয়ে আমিরের শারীরিক অবস্থা বেশি দুর্বল। মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত। রাখাইনের চোখে দেখা গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, বর্বর নির্যাতন–নিপীড়নের ঘটনা স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না আমির আলী। সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে করেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন। জমিলা পুরোনো কাপড়ে স্বামীর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন, এভাবে আর কত? ভালো-মন্দের বিচার আল্লাহর হাতে।
আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা রহিম উল্লাহ বলেন, লাইলি-মজনুর প্রেমকেও হার মানাবে আমির-জমিলার প্রেম। বৃদ্ধ বয়সেও একজন আরেকজনকে ফেলে কিছু খান না। কোথাও গেলে একসঙ্গে যান। যা থাকে, তা একসঙ্গে ভাগাভাগি করে খান। দুজনের মধ্যে বোঝাপড়াও দারুণ।