কুয়াশা ভেদ করে যখন সূর্যের আলো প্রকৃতিতে আসে, তখন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করে দিগন্তবিস্তৃত আমনের খেত। সোনামাখা রোদে মাঠে মাঠে ঝলমলিয়ে ওঠে সোনালি ধান। সেই ধানের ঝিলিক যেন ছড়িয়ে পড়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষকদের চোখেমুখে।
প্রকৃতিতে এখন হেমন্তকাল। হেমন্ত মানেই মাঠে মাঠে সোনালি ধানের হাসি আর নবান্নের উৎসব। আমন ধান ঘরে এলেই গ্রামবাংলার কৃষকদের চিরায়ত এক উৎসবের নাম নবান্ন। অগ্রহায়ণ মাসে ঘরে প্রথম ধান তোলার পর নতুন চাল দিয়ে উৎসবটি পালন করেন কৃষিজীবীরা।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পূর্ব বেগুনবাড়ি, গৌরীপুর, ধন্দোগাঁও, জগন্নাথপুরের বিভিন্ন এলাকার মাঠে মাঠে চলছে ধান কাটা। গানে গানে ধান কেটে চলছেন কৃষকেরা। পূর্ব বেগুনবাড়ি এলাকার কৃষক আনোয়ার হোসেন (৪৯) এবার দুই একর জমিতে আমন ধানের চাষ করেছিলেন। এখন জমির সেই ধান কাটতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। আনোয়ার বললেন, ‘ধানের ফলন ভালো হইচে। দামও ভালো পাইছু। হামার আর কী নোগে?’
একই গ্রামের আরেক কৃষক সনাতন রায় (৫২) দুই বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করেছেন। ফলনের ব্যাপারে তিনি বলেন, খরচ আর ধানের দাম মিলিয়ে এবার মোটামুটি লাভ হবে। ধান উঠলে যেই টাকা হাতে পাবেন, সেটা দিয়ে আবার আলু লাগাবেন তিনি।
খেত থেকে ধান কেটে আনার পর কৃষকেরা বাড়ির উঠানে মাড়াই করছেন। ধানের ম-ম গন্ধ এখন কৃষকের উঠানজুড়ে। কোথাও কোথাও বাড়ির গৃহিণীরা সামগাইনে (কাঠের তৈরি ধান-চাল গুঁড়া করার যন্ত্রবিশেষ) নতুন ধানের চাল গুঁড়া করছেন। চালের সেই গুঁড়ায় তৈরি হবে নানা রকমের সুস্বাদু পিঠা-পায়েস।
সদর উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামে প্রদীপ রায়ের বাড়িতে দেখা গেল, সামগাইনে চাল গুঁড়া করার ব্যস্ততা। কাজের ফাঁকে প্রদীপের স্ত্রী সুমিত্রা রায় বললেন, ‘নতুন ধানের পিঠা-পায়েস না খাইলে কী হয়? ছোট থেকেই নতুন ধানের চালের পিঠা খেয়ে আসছি। এই চালের গুঁড়া দিয়ে ভাপা, চিতই, গুরগুরিয়া, সেমাই, তেলপিঠাসহ কত পিঠা হবে!’
প্রদীপ রায়ের বাড়িতে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশীর বাড়ি থেকেও সামগাইনে চাল গুঁড়া করার শব্দ ভেসে এল। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, শফিকুলের স্ত্রী রওশন আরা চাল গুঁড়া করছেন। এ সময় রওশন আরা বলেন, ‘নতুন ধান উঠলেই সেই ধানে চাল করে গুঁড়া করি। নিজেদের গুঁড়া করা চালে তৈরি পিঠা অনেক মজা হয়। পিঠা বানানোর দিন আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা বাড়িতে আসেন। সবাই একসঙ্গে বসে পিঠা বানাই।’
নবান্ন উৎসবের মূল উদ্দেশ্য হলো নতুন ধান তোলার এই আনন্দ সবাই একসঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া। গ্রামবাংলার কৃষকদের এই আয়োজনকে অসাম্প্রদায়িক সামাজিক উৎসব বলে মনে করেন সমাজ-গবেষক ও স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা। তবে কালের বিবর্তনে ধীরে ধীরে নবান্ন উৎসবের পরিসর অনেকাংশে কমে গেছে।
সদর উপজেলার শিবগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আনছারুল হক বলেন, ‘আমাদের কৃষকেরা এই সময় নানা জাতের ধান আবাদ করতেন। আর সেই ধানে কৃষকের বাড়িতে বাড়িতে নতুন চালের ভাতের সঙ্গে পিঠা-পুলির উৎসব হতো। কিন্তু এখন আগের মতো সেই উৎসব খুব একটা দেখা যায় না।’
সমাজ-গবেষক ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক মুহম্মদ শহীদ উজ জামান বলেন, একসময় আড়ম্বরপূর্ণভাবে নবান্ন উৎসব উদ্যাপিত হতো। সব ধর্মের মানুষের জন্য অসাম্প্রদায়িক সামাজিক উৎসব হিসেবে সারা দেশেই নবান্ন উৎসব সমাদৃত ছিল। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই মিলে এ উৎসব উদ্যাপন করা হতো। তবে এখন মানুষের মধ্যে সামাজিক বন্ধন কমে গেছে। জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে নবান্ন উৎসবের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে যদি তৃণমূল পর্যায়েও বড় পরিসরে উৎসব আয়োজন করা যেত, তাহলে এই ঐতিহ্য দীর্ঘদিন টিকে থাকত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ঠাকুরগাঁও কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এবার এক লাখ ৩৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে চলতি মৌসুমে আমন ধান আবাদ হয়েছে। এই পরিমাণ জমি থেকে উৎপাদিত হবে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫৭৪ মেট্রিক টন ধান। সেই ধান থেকে ৪ লাখ ২৯ হাজার ৭১৬ মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হবে।