খুলনার কয়রা থেকে ডুমুরিয়ার বেতগ্রাম পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের কাজ ফেলে রাখায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন লোকজন
খুলনার কয়রা থেকে ডুমুরিয়ার বেতগ্রাম পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের কাজ ফেলে রাখায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন লোকজন

ব্যয় বেড়েছে, কাজে ধীরগতি

অধিকাংশ স্থানে বাঁক সরলীকরণের কাজ অসমাপ্ত রেখে সড়কের অন্য স্থানে পিচঢালাইয়ের কাজ চলছে। দুই পাশে গাইডওয়াল বেঁকে গেছে। 

খুলনার কয়রা-বেতগ্রাম সড়কের উন্নয়নকাজ চলছে ধীরগতিতে। সড়কটির ৬৪ কিলোমিটার প্রশস্ত ও বাঁক সরলীকরণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২০ সালে। এরই মধ্যে প্রকল্পটির দুই দফায় মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি বরাদ্দও বেড়েছে। তবে কাজ হয়েছে মাত্র ৬৪ শতাংশ। 

এলাকার লোকজন বলছেন, কাজ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। এ ছাড়া কাজের মান নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। তাঁরা দ্রুত মানসম্পন্নভাবে কাজ শেষ করার দাবি জানান।

খুলনা সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী আনিসুজ্জামান মাসুদ বলেন, ‘কাজের ধীরগতির কারণে আমরা ঠিকাদারকে কয়েকবার সতর্ক করে নোটিশ দিয়েছি। ঠিকাদার মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছেন। আর যেসব স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেসব স্থানসহ চলমান কাজ দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

কয়রা, পাইকগাছা ও সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মধ্য দিয়ে ডুমুরিয়া উপজেলার বেতগ্রাম পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটারের এ সড়কটি শেষ হয়েছে খুলনা-সাতক্ষীরা আঞ্চলিক মহাসড়কে। সরেজমিনে দেখা গেছে, কয়রার অংশের সংগ্রামের মোড়, পাইকগাছার লক্ষ্মীখোলাসহ কয়েকটি স্থানে বাঁক সোজা করার জন্য বালু ফেলা হয়েছে। অধিকাংশ স্থানে কাজ অসমাপ্ত রেখে সড়কের অন্য স্থানে পিচঢালাইয়ের কাজ চলছে। তবে কাজ শেষ করে অন্য অংশে যেতে না যেতেই ঢালাই উঠে যাচ্ছে। কোথাও-বা যানবাহনের চাকায় পিচঢালাই দেবে গিয়ে সড়কে ঢেউ খেলে গেছে। দুই পাশে গাইডওয়াল, প্যালাসাইডিং বেঁকে গেছে। 

কয়রা সদর থেকে পাইকগাছা উপজেলার মৌখালী সীমানা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়কের চারটি বাঁকসহ বেশ কিছু স্থানের প্রায় ৫ কিলোমিটার কাজ বাকি আছে। মৌখালী থেকে পাইকগাছার শেষ সীমানা কাশিমনগর পর্যন্ত ১৬টি বাঁকের কাজ ফেলে রাখায় ২-৩ কিলোমিটার পরপর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যানবাহন চালকদের। বাঁকের স্থানগুলোতে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। কাশিমনগর থেকে বেশ কিছুটা পথ স্বাচ্ছন্দ্যে অতিক্রম করা গেলেও তালা উপজেলা সদরের কাছাকাছি রামনগর এলাকা থেকে তালা ফায়ার স্টেশন পর্যন্ত কয়েক জায়গায় কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। সব মিলিয়ে ৬৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণকাজের ১৫-১৬ কিলোমিটার কাজ অসমাপ্ত থেকে গেছে। 

গাড়িচালক তুষার মণ্ডল বলেন, ৪০ বছর ধরে প্রতিদিন দুই বেলা সড়কটি দিয়ে যাতায়াত করছেন। এক দিনও এ পথে স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারেননি। সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে—এ খবরে খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু কাজের যে অবস্থা, তাতে দুর্দশা কবে কমবে, তা জানেন না। চার বছর ধরে কাজ হচ্ছে, এখনো একটি বাঁকও সোজা হয়নি।

ট্রাকচালক আলমগীর হোসেন বলেন, খুলনা শহর থেকে বেতগ্রাম পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটারে স্বাভাবিক গতিতে যানবাহন পৌঁছাতে সময় লাগে ৪০ মিনিট। অথচ বেতগ্রাম থেকে কয়রা সদর পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটার পথে সময় লাগে প্রায় ৪ ঘণ্টা। সড়কের ওই অংশে অতিরিক্ত বাঁক আর খারাপ রাস্তার কারণে সময় নষ্ট হয়।

সড়কটি সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের আওতাধীন। ২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি কয়রা-খুলনা আঞ্চলিক মহাসড়কের বেতগ্রাম-তালা-পাইকগাছা ও কয়রা অংশের ৬৪ কিলোমিটার সড়ক যথাযথ মানে উন্নীতকরণ প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য অনুমতি পায় মোজাহার এন্টারপ্রাইজ। সে সময় ব্যয় ধরা হয় ৩৩৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। ২০২২ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় ঠিকাদারের আবেদনে সময় বাড়ানো হয়। পরে আরেক দফা সময় ও বরাদ্দ বাড়ালেও কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হয় প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আর বর্তমানে প্রকল্পের বরাদ্দ বেড়ে ৩৭৯ কোটি ৪৮ লাখে এসে দাঁড়িয়েছে।

সওজ বিভাগের খুলনা কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পের অগ্রগতি ৬৪ দশমিক ২০। পাঁচটি প্যাকেজে বিভক্ত এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ৬৪ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার ও ঝুঁকিপূর্ণ ৩০টি বাঁক সরলীকরণ। এ ছাড়া ১০০ মিটার নদীশাসনের কাজও আছে এ প্রকল্পে। 

মোজাহার এন্টারপ্রাইজের প্রকল্প ব্যবস্থাপক রাজন বলেন, প্রকল্পের ৩০টি বাঁক সরলীকরণের জন্য জমি অধিগ্রহণে সময়ক্ষেপণ হয়েছে। সড়কটি নির্মাণে সওজের প্রকৌশলীদের নির্দেশনা মেনে এবং প্রাক্কলন অনুসরণ করেই কাজ করা হচ্ছে। তারপরও কাজ করতে গেলে টুকটাক সমস্যা হয়। চলমান কাজে যেসব স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেই স্থানও ঠিক করে দেওয়া হবে। 

খুলনা সওজের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী প্রসেনজিৎ পাল বলেন, কাজের বিভিন্ন বিষয়ে ঠিকাদারের গাফিলতি রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত ও জরিমানার সুপারিশ করা হয়েছে। 

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম ও সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, আশির দশকে এ পথে কয়রা থেকে খুলনা জেলা শহরে যাতায়াত শুরু হয়। সে সময় কয়রা থেকে পাইকগাছা পর্যন্ত কাঁচা রাস্তা ছিল। পাইকগাছা থেকে বেতগ্রাম পর্যন্ত ছিল ইট বিছানো রাস্তা। ১৯৯৮ সালের শুরুতে সড়কে বাস চলাচল শুরু হয়। তবে সড়কের প্রশস্ততা কম ও অর্ধশত বাঁক থাকায় যাতায়াতে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয় চালকদের। ওই সময় থেকে সড়কটি প্রশস্তকরণ ও বাঁক সোজা করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন এ অঞ্চলের মানুষ। দীর্ঘ ২২ বছর পর সে দাবি বাস্তবায়নে সড়কে কাজ চলছে। তবে যে গতিতে কাজ চলছে, তাতে এবারও নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।