বৈষ্যম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকার কদমতলী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন সুমন ব্যাপারী (৩৫)। অস্ত্রোপচার হয়েছে; তবে তিনি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারছেন না। পাইপের মাধ্যমে তাঁকে প্রস্রাব করতে হচ্ছে। সুমন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য। আয়ের পথ বন্ধ হওয়ায় তাঁরা বিপাকে পড়েছেন। এদিকে আর্থিক অনটনে সুমনের উন্নত চিকিৎসা হচ্ছে না।
সুমন ব্যাপারীর বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ধূলিয়া ইউনিয়নের মঠবাড়িয়া গ্রামে। বাবা আবদুল গনি ব্যাপারী মারা গেছেন। স্ত্রী, দুই ছেলে–মেয়ে ও মাকে নিয়ে তাঁর সংসার। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সুমন দ্বিতীয়। বসতভিটার ৫ শতক জমি ছাড়া আর কিছু নেই তাঁদের।
এক যুগ আগে সুমনের বাবা আবদুল গনি ব্যাপারী মারা যান। এলাকায় দিনমজুরের কাজ করতেন সুমন। প্রায় সাত বছর আগে তিনি ঢাকায় যান; কাজ শুরু করেন রায়েরবাগ এলাকার মশার কয়েল তৈরির একটি কারখানায়। ওই কারখানার মেসেই তিনি থাকতেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা থাকতেন গ্রামের বাড়িতে।
সুমন জানান, ১৫ জুলাই থেকে আন্দোলনে অংশ নিচ্ছিলেন। ১৯ জুলাই বেলা সাড়ে তিনটার দিকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে কদমতলী থানার কাছে যান। ওই মিছিলে তিনিও ছিলেন। থানার কাছে পৌঁছালে পুলিশ গুলি ছোড়ে। তাঁর ঊরুতে গুলি লাগে। আন্দোলনকারী ছাত্ররা তাঁকে উদ্ধার করেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রাত আটটার দিকে জ্ঞান ফিরে দেখতে পান তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায়। পরে জানতে পারেন, তাঁকে এর আগে আরও দুটি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরদিন সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করা হয়। কেটে ফেলা হয় তাঁর অণ্ডকোষের একাংশ।
হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সময় পুলিশের হয়রানি ও গ্রেপ্তার–আতঙ্কে ছিলেন সুমন। তিনি বলেন, সাদাপোশাকে পুলিশ পরিচয়ে তাঁর নাম–ঠিকানা ও হাতের ১০ আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়েছিল। পাশের শয্যার লোকজন জানিয়েছিলেন, কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেই হাসপাতাল থেকে শাহবাগ থানায় নেওয়া হচ্ছে আন্দোলনকারীদের। সেই ভয়ে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কথা গোপন রেখেছিলেন সুমন। ২৭ জুলাই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান তিনি। হাসপাতালের একজন নার্সের সহায়তায় পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পান। ঢাকা মেডিকেল থেকে বের হয়ে ওই দিনই গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন তিনি।
আমার আয়েই সংসার চলত। এখন উন্নত চিকিৎসার খরচ ও সংসার চালামু কীভাবে—কিছুই বুঝতে পারছি না।সুমন ব্যাপারী, আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত
এখনো স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারছেন না সুমন। তিনি জানান, তীব্র যন্ত্রণা হয়। প্রস্রাব করতে হয় তলপেট ছিদ্র করে বের করা পাইপের সাহায্যে। গুলি বের করা ও অণ্ডকোষের কেটে ফেলা সেলাইয়ের দিকে চোখ পড়লেই নিস্তেজ হয়ে যায় শরীরের সব শক্তি। রোজ ৪০০ টাকার ইনজেকশন লাগে। ওষুধপথ্য, ড্রেসিংসহ প্রতিদিন এক হাজারের বেশি টাকা খরচ হচ্ছে।
সুমন বলেন, ‘আমার আয়েই সংসার চলত। এখন উন্নত চিকিৎসার খরচ ও সংসার চালামু কীভাবে—কিছুই বুঝতে পারছি না। আর চিকিৎসা করাতে না পারলে পুরুষত্ব হারিয়ে যাবে কি না, সেই চিন্তায় আছি। কোনো কিছুই ভালো লাগে না।’
সুমনের মা সুমি বেগম (৬০) বলেন, ‘এই ছেলের (সুমন) উপার্জনের ওপর আমাগো নির্ভর। হেইয়া এহন পইরা রইছে। আমাগো চিকিৎসা চালাবার মতো কোনো সামর্থ নাই। আমার পোলার বউ আছে, দুইডা পোলা-মাইয়া আছে। আমাগো ভবিষ্যত যে কী হইবে? কী করমু? কিছুই বুজতে পারছি না।’
প্রতিবেশী জসিম উদ্দিন (৩০) বলেন, সুমনের পরিবার খুবই দরিদ্র। তাঁর চিকিৎসা নিয়ে পরিবার খুবই চিন্তিত। তাদের পক্ষে চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। সমাজে যাঁরা বিত্তবান আছেন, তাঁদের এগিয়ে আসা দরকার।
বাউফলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ধূলিয়া কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র হুজাইফা বলে, ছাত্র–জনতার আন্দোলনে যাঁরা আহত হয়েছেন, এই সরকারের উচিত তাঁদের পাশে দাঁড়ানো, যাতে তাঁরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন।