কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের লাবণী পয়েন্ট। গতকাল শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে উত্তাল সমুদ্রে নেমে গোসলে ব্যস্ত প্রায় ১০ হাজার পর্যটক। এ সৈকতে কয়েক দিন আগে সৃষ্টি হয়েছে বড় দুটি খাল। জোয়ার-ভাটার কারণে খালের দিক পরিবর্তন হয় বলে এই খালকে বলা হচ্ছে গুপ্তখাল। গত সাত দিনে গুপ্তখালে আটকা পড়ে দুই পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। আর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে অন্তত ১৫ পর্যটককে।
গুপ্তখালের আশপাশে (বালুচরে) লোকজনকে গোসলে নামতে নিষেধ করে ওড়ানো হচ্ছে একাধিক লাল নিশানা। পর্যটকদের সতর্ক করতে সৈকতে চলছে প্রচার, কিন্তু সেদিকে কারও নজর নেই। তপ্ত রোদ ও দাবদাহের মধ্যে লোকজন সমুদ্রে ঝাঁপ দিচ্ছেন, লোনাপানিতে শরীর ভিজিয়ে ফিরছেন হোটেলে।
লাবণী পয়েন্টের উত্তর দিকে সিগাল, সুগন্ধা ও কলাতলী সৈকতের অবস্থা আরও ভয়াবহ। চারটি পয়েন্টের অন্তত ৫ কিলোমিটার সৈকতে নেমেছেন অন্তত ৫০ থেকে ৬০ হাজার পর্যটক। অর্ধেক মানুষ সমুদ্রের পানিতে, বাকিরা বালুচরে পাতা ছাতার নিচে বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ পায়চারী করে সময় কাটাচ্ছেন। বেসরকারি লাইফগার্ড সি সেফ প্রতিষ্ঠানের ২৭ জন এবং জেলা প্রশাসনের নিয়োগপ্রাপ্ত ৩৭ জন বিচ কর্মী গোসলে নামা পর্যটকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। সাঁতার না–জানা অনেকে টিউবে গা ভাসিয়ে গভীর সমুদ্রের দিকে চলে যান। বড় বড় ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উল্লাসে মাতে তরুণ-কিশোরের দল। হলুদ শার্টের লাইফগার্ড কর্মীর চোখ সেদিকে। তাঁরা বাঁশি বাজিয়ে, কাছে গিয়ে তাঁদের সতর্ক করেন। কাউকে জোর করে কূলে তুলে আনছেন। কিন্তু এক দিক থেকে তুলে আনলেও অন্য দিক থেকে আরও লোকজন গভীর সমুদ্রের দিকে চলে যান।
শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে সুগন্ধা সৈকতে কথা হয় সি সেফ লাইফগার্ড প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট সুপারভাইজার সিফাত সাইফুল্লাহর সঙ্গে। তখনো সুগন্ধা সৈকতের মাত্র এক কিলোমিটার এলাকায় ১৫ থেকে ২০ হাজার পর্যটকে ভরপুর। তপ্ত রোদ ও দাবদাহ পরিস্থিতিতে অতিষ্ঠ লোকজন সমুদ্রের পানিতে নেমে পড়ছেন।
সিফাত সাইফুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুপুর ১২টা পর্যন্ত কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটারে নেমেছেন অন্তত ৫৫ হাজার পর্যটক। সন্ধ্যা নাগাদ এর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে। তখন স্থানীয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার লোকও সৈকতে নামবেন, কিন্তু অনেকে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সমুদ্রে গোসলে নেমে বিপদে পড়ছেন। কয়েক দিনে সৈকতের লাবণী পয়েন্টে বড় দুটি গুপ্তখালের সৃষ্টি হয়েছে। ওই গুপ্তখালে আটকা পড়ে দুই পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। গত সাত দিনে লাবণী, সুগন্ধা, সিগাল ও কলাতলী সৈকতে গোসলে নেমে স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার সময় অন্তত ৪৫ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে ১৫ থেকে ১৭ জনকে। আর দুই পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে লাবণী পয়েন্টের গুপ্তখালে আটকা পড়ে।’
পুলিশ ও লাইফগার্ড কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২৫ এপ্রিল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে সৈকতের লাবণী পয়েন্টে গোসলে নামেন চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানার শোলকবহর এলাকার শাহজাহান (৪০)। প্রায় এক ঘণ্টা তাঁরা টিউবে গা ভাসিয়ে ঢেউয়ের সঙ্গে খেলতে থাকেন। বেলা দেড়টার দিকে ঢেউয়ের ধাক্কায় পানিতে ছিটকে পড়েন শাহজাহান। লাইফগার্ড কর্মীরা বেলা আড়াইটার দিকে শাহজাহানের লাশ উদ্ধার করেন।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, গত শনিবার লাবণী পয়েন্টে ১০ থেকে ১২ জন পর্যটক দল বেঁধে গোসলে নেমে নিখোঁজ হন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মাঝুখানের রাস্তার মাথা এলাকার আক্কাছ আলীর ছেলে মো. হিমেল আহমদ (২০)। বৃহস্পতিবার বিকেলে জোয়ারের পানিতে তাঁর লাশ ভেসে ওঠে পাঁচ কিলোমিটার দূরে শহরের বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছটা প্যারাবনের কাছে।
জেলা প্রশাসনের পর্যটন শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাসুম বিল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, হিমেল আহমদের সঙ্গে ১০ থেকে ১২ জন সমুদ্রে গোসলে নেমেছিলেন। হিমেল স্রোতের টানে ভেসে গেলেও বিচ কর্মীরা তৎক্ষণাৎ ৮ থেকে ৯ জনকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন। গুপ্তখালের আশপাশে গোসলে নামতে নিষেধ করে সৈকতে একাধিক লাল নিশানা তোলা হয়েছে। দূর থেকেও লাল নিশানা উড়তে দেখা যায়। পর্যটকদের সতর্ক করতে চলছে প্রচারণাও, কিন্তু লোকজনের সেদিকে নজর নেই। সমুদ্র দেখেই লোকজন ঝাঁপ দিচ্ছেন। পর্যটক বলে কঠোর হওয়া যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, ঈদের ছুটির ছয়-সাত দিনে সৈকত ভ্রমণে আসেন পাঁচ লাখের বেশি পর্যটক। এখনো লাখো পর্যটক সৈকতে অবস্থান করছেন। বিপুলসংখ্যক মানুষের নিরাপত্তা এবং সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
কক্সবাজার হোটেল-গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ বলেন, ঈদের দ্বিতীয় দিন থেকে সৈকতে পর্যটকের আগমন শুরু হয়েছে। সাত দিনে সৈকতে ভ্রমণে এসেছেন ছয় লাখের মতো পর্যটক। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত পর্যটকের সমাগম থাকতে পারে।
৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিনে আট লাখ পর্যটক ভ্রমণের কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, পাঁচ শতাধিক হোটেল, গেস্টহাউস হাউস, রিসোর্ট, কটেজ, সাত শতাধিক রেস্তোরাঁসহ পর্যটনসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা হবে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। কিন্তু সমুদ্রে নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা না থাকায় এবং গোসলে নেমে পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনায় পর্যটনশিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশ্বের দীর্ঘতম ১২০ কিলোমিটার সৈকতের মধ্যে শহরের কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত ৫ কিলোমিটারে ৬০ জনের বেশি লাইফগার্ড ও বিচ কর্মী থাকলেও অবশিষ্ট ১১৫ কিলোমিটার সৈকত অরক্ষিত। অরক্ষিত সৈকতের দরিয়ানগর, হিমছড়ি, ইনানী, পাটোয়ার টেক ও টেকনাফ সৈকতে গোসলে নামছেন হাজারো পর্যটক। স্রোতের টানে সেখানে কেউ ভেসে গেলে উদ্ধারের কেউ নেই।
সৈকতে সৃষ্ট গুপ্তখাল কিংবা বড় গর্তে আটকা পড়ে গত ১৮ বছরে ১২৬ জন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী। তিনি বলেন, গোসলে নেমে কেউ মারা গেলে তার দায়ও নেয় না কেউ। কক্সবাজারের হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিক ও পর্যটন ব্যবসায়ীদের সবাই পর্যটকসেবার নামে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন, কিন্তু পর্যটকদের নিরাপত্তা, বিনোদনসেবা বৃদ্ধি এবং থাইল্যান্ডের পাতায়ার মতো সৈকতের অল্প একটু জায়গাতে ‘সুইমিং জোন’ প্রতিষ্ঠা করে পর্যটকের নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা করতে পারছে না।