নাফ নদীতে ডুবোচর ও নাব্যতা–সংকটের কথা বলে চলতি মৌসুমের শুরু থেকে (১ নভেম্বর) কক্সবাজারের টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ রেখেছে প্রশাসন। অথচ কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে একাধিক বিলাসবহুল জাহাজে চড়ে হাজারো পর্যটক সেন্ট মার্টিনে ভ্রমণে যাচ্ছেন।
এতে সেন্ট মার্টিনে পর্যটকদের পরিবহনের বিষয়টি ঢাকাকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে বলে অভিযোগ করেছে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে বন্ধ থাকা জাহাজগুলোর একাধিক মালিক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা দাবি করেন, এতে বিপাকে পড়েছেন এ নৌপথে চলাচলকারী জাহাজ, স্পিডবোট, কাঠের ট্রলারসহ টেকনাফের দোকানপাটের ব্যবসায়ীরা।
বর্তমানে কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন নৌপথে এম ভি কর্ণফুলী এবং চট্টগ্রাম-সেন্ট মার্টিন নৌপথে বে ওয়ান জাহাজ চলাচল করে। জাহাজ দুটি একই প্রতিষ্ঠানের। কর্ণফুলী জাহাজের কক্সবাজারের ব্যবস্থাপক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর প্রথম আলোকে বলেন, জাহাজ দুটি সরকারি অনুমোদন নিয়ে গত বছরও এ নৌপথে চলাচল করেছে। এ বছরও নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে চলছে। টেকনাফে জাহাজ চলাচল বন্ধের সঙ্গে জাহাজ দুটি চলাচলের কোনো সম্পর্ক নেই।
এর আগে এক যুগের বেশি সময় ধরে টেকনাফ থেকে ১০টি জাহাজে করে পর্যটকেরা সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে যেতেন।
অনেক পর্যটকের প্রশ্ন, নাফ নদীতে যদি নাব্যতা-সংকট হয়, তাহলে মিয়ানমার থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে আমদানি পণ্যবোঝাই জাহাজ আসা–যাওয়া করে কীভাবে? এ ছাড়া নাব্যতা–সংকট হলে টেকনাফের পশ্চিম সৈকতের সাবরাং পয়েন্ট দিয়ে সেন্ট মার্টিনে জাহাজ চলাচল চালু রাখা যেত।
টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখার কারণ হিসেবে নাব্যতা–সংকটের কথা উল্লেখ করে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, এই নৌপথে জাহাজ চালুর বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা তিনি পাননি। বিকল্প পথে টেকনাফ থেকে জাহাজ চালুর বিষয়ে ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশনা পেলে জাহাজ চালাতে সমস্যা নেই।
তিন বছর ধরে সরকারিভাবে পর্যটকের আগমন সীমিত করে সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কথা বলা হচ্ছে। অথচ কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে একাধিক বিলাসবহুল জাহাজে চড়ে হাজারো পর্যটক আসছেন। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ স্থানীয় প্রশাসন নীরব।দীপক শর্মা , সভাপতি, কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা প্রথম আলোকে বলেন, আগে অল্প খরচে মধ্যবিত্তরা টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন যাতায়াতের সুযোগ পেতেন। এখন কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে বিলাসবহুল জাহাজে যেতে খরচ হচ্ছে তিন থেকে চার গুণ টাকা। সময়ও লাগছে বেশি। সেন্ট মার্টিনের পর্যটন ব্যবসা এখন নিয়ন্ত্রণ করছে ঢাকাকেন্দ্রিক সিন্ডিকেট।
তবে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে চলাচলকারী জাহাজমালিকদের সংগঠন সি-ক্রুজ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (স্কোয়াব) সভাপতি তোফায়েল আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘টেকনাফ থেকে জাহাজ চলাচলের চেষ্টা চলছে। আশা করছি, জানুয়ারি দ্বিতীয় সপ্তাহে জাহাজ চলাচল শুরু হবে।’
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের উত্তর ও পশ্চিম সৈকতে গিয়ে অনেক পর্যটকের সঙ্গে কথা হয়। ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা পর্যটক শামসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আগের টেকনাফ থেকে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় সেন্ট মার্টিন আসা-যাওয়া করা যেত। সময় লাগত আড়াই ঘণ্টা। টেকনাফ থেকে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় এখন কক্সবাজার থেকে জনপ্রতি তিন হাজার টাকা দিয়ে টিকিট কেটে সেন্ট মার্টিন আসতে হলো। কিন্তু সমুদ্রযাত্রায় পরিবারের লোকজন জাহাজে বমি করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে রাজশাহী থেকে দ্বীপ ভ্রমণে আসেন ব্যবসায়ী হামিদুর রহমান। তিনি বলেন, কক্সবাজার থেকে গভীর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তাঁদের সেন্ট মার্টিন যেতে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা সময় লেগেছে। ভাড়াও অনেক বেশি। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে যে পরিমাণ টাকা খরচ হচ্ছে, তা দিয়ে উড়োজাহাজে কলকাতা ঘুরে আসা যায়।
১ নভেম্বর থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত পর্যটন মৌসুম ধরা হয়।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পূর্বঘোষণা ছাড়াই চলতি মৌসুমে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে এই নৌপথে ১০ বছর ধরে চলাচলকারী ১০টি জাহাজ, শতাধিক স্পিডবোট, কাঠের ট্রলারসহ টেকনাফের দোকানপাটের ব্যবসায়ীরা পথে বসেছেন। ১ নভেম্বর থেকে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় টেকনাফের দমদমিয়া জেটিঘাট, টেকনাফ পৌরসভা, শাহপরীর দ্বীপ, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জেটিঘাট, সমুদ্রসৈকতসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় তিন হাজার দোকানপাট বন্ধ রয়েছে।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, আগে পর্যটন মৌসুমের এক দিনে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে যেতেন। বছরে ভ্রমণ করতেন ১৫ লাখের বেশি মানুষ। তিন বছর ধরে সরকারিভাবে পর্যটকের আগমন সীমিত করে সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কথা বলা হচ্ছে। অথচ কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে একাধিক বিলাসবহুল জাহাজে চড়ে হাজারো পর্যটক আসছেন। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ স্থানীয় প্রশাসন নীরব। এ কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।