‘আমার ছেলেটিকে অনেক কষ্টে লেখাপড়া করাচ্ছিলাম। নাশকতা ঠেকাতে সে স্বনির্ভর এলাকায় পাহারা দিতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। বলে গেছে, “মা, দীঘিনালায় পাহাড়িদের দোকান পুড়িয়ে দিয়েছে। এখানেও দিতে পারে। তুমি ঘুমাও। আমি চলে আসব একটু পর।” আর এল না। আমার ছেলেটাকে গুলি করে মারল।’
খাগড়াছড়ি সদরের ধর্মপুর যুবরাজপাড়ার বাড়ির আঙিনায় বসে ছেলের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন মা রূপসী চাকমা। জুনান চাকমা (২১) ১৯ সেপ্টেম্বর স্বনির্ভর এলাকায় গুলিতে মারা যান। একই স্থানে গুলিতে মারা যান রুবেল রওজা ত্রিপুরা (২১)। ওই দিন বিকেলে দীঘিনালায় পাহাড়ি–বাঙালি সংঘর্ষের সময় প্রতিপক্ষের পিটুনিতে ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) নামের এক ব্যক্তি নিহত হন। রাতে স্বনির্ভরে গোলাগুলিতে দুজন নিহত হন। আহত হন অন্তত ২০ জন। গুলিবিদ্ধ পাঁচজন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
নিহত তিন পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এটা খুবই নগণ্য বলে মনে করছেন স্বজনেরা। পল্টনজয় পাড়ার সাবেক ইউপি সদস্য সরলা চাকমা বলেন, এত কম ক্ষতিপূরণে গরিব মানুষগুলো কীভাবে চলবে।
দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় জুনান চাকমা এবার পানছড়ি সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। জুনান আউটসোর্সিংয়ের কাজ নিয়েছিলেন। মা রূপসী বলেন, ‘সেদিন যখন ঘরে বসে গুলির শব্দ শুনি, তখন মন আর মানছিল না। রাত ১২টার দিকে বের হয়ে পড়ি ছেলের খোঁজে। উইফা স্কুলের ওখানে যাই। দেখি, হাজার হাজার মানুষ। তাকে পাইনি। পরে চলে আসি। ছোট ছেলে কিছুক্ষণ পর মোবাইলে দেখে বলে, মা দাদা গুলি খেয়েছে।’
রাজমিস্ত্রি রুবেলের লাশও ছিল সদর হাসপাতালে। রুবেলের বাড়ি সদর উপজেলার প্যারাছড়া ইউনিয়নের পল্টনজয় পাড়ায়। ওই পাড়ায় উঁচু একটা টিলায় রুবেলদের বাড়ি। বাড়ি বলতে একটি বেড়ার ঘর, খড়ের ছাউনি।
সেদিন যখন ঘরে বসে গুলির শব্দ শুনি, তখন মন আর মানছিল না। রাত ১২টার দিকে বের হয়ে পড়ি ছেলের খোঁজে। উইফা স্কুলের ওখানে যাই। দেখি, হাজার হাজার মানুষ। তাকে পাইনি। পরে চলে আসি। ছোট ছেলে কিছুক্ষণ পর মোবাইলে দেখে বলে, মা দাদা গুলি খেয়েছে।রূপসী চাকমা
বাবা খরগোসি মনি রওজা ছেলের মৃত্যুর পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। মা নিরন্তা দেবী বলেন, ‘সেদিন সকালে কাজে বেরিয়ে সন্ধ্যায় আর বাড়ি ফেরেনি ছেলে। ভোররাতে খবর পেলাম, আমার ছেলে গুলিতে মারা গেছে।’
নিহত তিন পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এটা খুবই নগণ্য বলে মনে করছেন স্বজনেরা। পল্টনজয় পাড়ার সাবেক ইউপি সদস্য সরলা চাকমা বলেন, এত কম ক্ষতিপূরণে গরিব মানুষগুলো কীভাবে চলবে।
সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পাঁচজনই গুলিবিদ্ধ। নিহত রুবেলের বন্ধু রাজমিস্ত্রি বিজয় চাকমাও ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বিজয় বলেন, ‘বিনা উসকানিতে সেদিন আমাদের ওপর আর্মি গুলি করেছে।’
১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি শহরে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মো. মামুন নামের এক যুবক গণপিটুনিতে নিহত হন। এর প্রতিবাদে পরদিন দীঘিনালায় বাঙালিরা মিছিল বের করেন। মিছিলে বাধা দেওয়ার অভিযোগে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে জড়ায়। একপর্যায়ে বাজারের মাইকে বাঙালিদের ওপর আক্রমণ হওয়ার ঘোষণা আসে। এরপর হাজার হাজার মানুষ বের হয়ে আসেন। একসময় দীঘিনালা লারমা স্কয়ারে দোকানে আগুন দেওয়া হয়।