আলুর লেট ব্লাইট (নাবিধসা বা মড়ক) রোগের জন্য দায়ী ছত্রাকের জিনোটাইপ (জিনের বিন্যাস) ও ফিনোটাইপ (বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য) শনাক্তকরণের গবেষণা করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. রসিদুল ইসলাম।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৯০ শতাংশ জমিতে ছত্রাকটির যে জিনোটাইপ পাওয়া গেছে, সেটি হলো ‘ইইউ-১৩-এ২’, যেটি ব্লু-১৩ হিসেবেও পরিচিত। এই বৈশিষ্ট্যের ছত্রাক দমনের জন্য জৈবিক ছত্রাকনাশক ও সেগুলোর প্রয়োগের পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করেন তিনি। এই ছত্রাকের বিস্তারিত নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে তাঁর সঙ্গে।
ছত্রাকের জিনোটাইপ ও ফিনোটাইপ শনাক্তকরণ গবেষণা কত সালে শুরু করেন?
রসিদুল ইসলাম: আলুর মড়ক রোগ ছত্রাকজনিত একটি মারাত্মক রোগ। এর কারণে আলু নষ্ট হওয়া, অতিরিক্ত ছত্রাকনাশক প্রয়োগ ও অন্যান্য বিষয় মিলিয়ে প্রতি মৌসুমে ৬ হাজার থেকে সর্বোচ্চ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। মূলত এই ক্ষতি কমাতেই ২০১৪ সাল থেকে ছত্রাকের জিনোটাইপ ও ফিনোটাইপ শনাক্তকরণ এবং এর জৈবিক ছত্রাকনাশক উদ্ভাবনের কাজটি শুরু করা হয়। ওই সময় দেশের ১৫টি জেলা থেকে মড়ক রোগাক্রান্ত মোট ৯০টি আলুর পাতার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্লু-১৩ জিনোটাইপের ছত্রাকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত আরেকটি বিষয় হলো যে একই ছত্রাকনাশক দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যবহার করার কারণে জিনোটাইপটি এখন রাসায়নিক ছত্রাকনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এ কারণে এই জিনোটাইপকেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মড়ক রোগের জন্য দায়ী ছত্রাকের জিনোটাইপ হিসেবে ধরা হয়েছে।
গবেষণার অর্থায়ন ও অন্যান্য কাজে কোন কোন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা পেয়েছেন?
রসিদুল ইসলাম: ২০১৪ সালে গবেষণার শুরুতে এর কোনো স্থায়ী অর্থায়ন ছিল না। সে সময় যুক্তরাজ্যের দ্য জেমস হাটন ইনস্টিটিউটের কারিগরি সহায়তায় গবেষণার পরীক্ষণবিষয়ক কাজগুলো চলতে থাকে। পরে ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এতে অর্থায়ন করে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস ও ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচার। ৪ বছরে মোট আর্থিক বরাদ্দ ছিল ৩৫ লাখ টাকা। তাদের অর্থায়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের ব্যাকটেরিওলজি অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি গবেষণাগারে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
উৎপাদন ঠিক রাখতে কোন কোন জৈব ও রাসায়নিক ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে?
রসিদুল ইসলাম: ছত্রাকের নির্দিষ্ট জিনোটাইপ উন্মোচনের পর এটি নির্মূলের উপায় খুঁজতে শুরু করি। আলু রোপণের আগেই সে ক্ষেত্রে কিছু কিছু ব্যবস্থা নিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। রোপণের আগেই আমাদের উদ্ভাবিত জৈব ছত্রাকনাশক-১ ও ২, অর্থাৎ উপকারী ফরমুলেশন ব্যাকটেরিয়া (সিউডোমোনাস পুটিডা ও ব্যাসিলাস সাবটিলাস) দ্বারা বীজ শোধন (প্রতি কেজিতে ৫ গ্রাম) করে নিতে হবে। এ ছাড়া বীজ রোপণের ৩০ দিন পরে উপকারী ফরমুলেশন ব্যাকটেরিয়া প্রতি লিটার পানিতে ৩ থেকে ৫ গ্রাম মিশিয়ে ৬ থেকে ৮ বার ৫ থেকে ৭ দিন পর পর প্রয়োগ করতে হবে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতেই মূলত মড়ক রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। এ সময় সংক্রমণ তীব্র মাত্রায় হতে থাকলে ছত্রাকনাশক (ডাইথেন এম-৪৬ বা ইন্ডোফিল এম-৪৫) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ২ থেকে ৩ বার ৬ থেকে ৭ দিন পর পর এমনভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে, যাতে গাছ ভালোভাবে ভিজে যায়। তবে উৎপাদন ঠিক রাখতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো রোগ ও জীবাণুমুক্ত বীজ ব্যবহার করা।
আশপাশের জমিতে মড়ক রোগ দেখা দিলে কৃষকের করণীয় কী?
রসিদুল ইসলাম: মড়ক হলো একটি মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ। বাতাসের মাধ্যমেও এটি এক জমি থেকে অন্য জমিতে ছড়িয়ে পড়ে। একটি গাছ আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগটি পুরো জমিতে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় প্রতিরোধী কোনো ব্যবস্থা না নিলে ছত্রাক আক্রমণের তীব্রতার পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন কমার আশঙ্কা থাকে সর্বোচ্চ ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ। এমন অবস্থায় ছত্রাকনাশক আগামভাবে প্রয়োগ করতে হবে। তবে রোগ সংক্রমণ শুরু হয়ে গেলে ‘সাইমোক্সানিল ও ম্যানকোজেব মিশ্রণ’ বা ‘সাইমোক্সালিন ও ডাইমেথোমর্ফ মিশ্রণ’ অথবা ‘ডাইমেথোমর্ফ ও ম্যানকোজেব মিশ্রণ’ ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৩ থেকে ৪ বার ৪ থেকে ৫ দিন পর পর প্রয়োগ করতে হবে।