স্ত্রী সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। প্রথমবারের মতো বাবা হবেন সোহেল রানা (৩০)। খুশিতে খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলেন। ঢাকায় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন তিনি। স্ত্রীকে নিয়েই ভাড়া বাসায় থাকতেন। তবে বাসায় একা থাকতে হয় দেখে স্ত্রীকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেন সোহেল। শেষবার যখন স্ত্রীর সঙ্গে সোহেল রানার মুঠোফোনে কথা হয়, তখন তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘চিন্তা কোরো না, বাবুটা পৃথিবীতে যেদিন আসবে, তার আগেই সময়মতো আমি পৌঁছে যাব। তোমার আগেই আমার বাবুটাকে আমি কোলে নিয়ে আদর করব।’
সন্তানকে কোলে নিয়ে সেই আদর করার ইচ্ছাটুকু আর পূরণ হয়নি সোহেল রানার। সন্তান পৃথিবীতে আসার অগেই ৫ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন তিনি। বগুড়া নন্দীগ্রাম উপজেলার ভাটগ্রাম ইউনিয়নের ভুস্কর দিনমজুর ফেরদৌস প্রামাণিকের ছেলে সোহেল। কাহালু ডিগ্রি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করে তিনি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন।
সোহেল রানার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাগলপ্রায় মা মাবিয়া বিবি। শোক কাটছেই না। কান্না করতে করতে তিনি বলেন, ‘ব্যাটার বউডা সাত মাসের পোয়াতি। এক দিন আগে বউ ডাক ব্যাটা ফোনে কচলো, “চিন্তা কইরো না, সময়মতো পৌঁছে যামো। সগলির আগে ছলডাক কোলত লিয়ে আদর করমো।” হামার বুকের ধনডাক ক্যান ওরা গুলি করে মারল? ব্যাটার বউডা সাত মাসের পোয়াতি। বউডার কী হবি, সংসারডা ক্যাংকা করে চলবি? প্যাটের ছলডা তো আর বাপ খুঁজে পাবি না। ছলডাক দেকপি বলে আসপার চাচলো, অ্যাসলো লিজেই লাশ হয়্যা।’
সোহেল রানার বড় ভাই শিহাব উদ্দিন প্রামাণিক প্রথম আলোকে বলেন, সোহেল রানা খুবই পরিশ্রমী ছিলেন। পড়ালেখার প্রতি তাঁর অন্য রকম ঝোঁক ছিল; কিন্তু সংসারে অভাব-অনটনের কারণে পড়ালেখা বন্ধ হয়। সংসারের হাল ধরতে ২০১৩ সালের দিকে ঢাকায় গিয়ে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কাজ নেন। চাকরির পাশাপাশি পড়ালেখা চালিয়ে স্নাতক পাস করেন। স্নাতকোত্তরেও ভর্তি হন।
সোহেল রানার গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে তাঁর মুঠোফোনে বেশ কিছু ভিডিও ধারণ করেন। ভাইয়ের মুঠোফোন থেকে সেই ভিডিও ফুটেজ দেখিয়ে শিহাব উদ্দিন প্রামাণিক বলেন, সেদিন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে গণভবন অভিমুখে ছাত্র-জনতার সঙ্গে মিছিলে যোগ দেন সোহেল রানা। দুপুরের দিকে আন্দোলনকারীরা অবস্থান করছিলেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায়। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে গুলিতে অনেকেই নিহত হন।
ভাইয়ের সঙ্গে শেষ কী কথা হয়েছিল, জানতে চাইলে সিহাব উদ্দিন বলেন, ‘খামারের গরু বিক্রি করে বিদেশ গিয়েছিলাম। কিছুদিন পর দেশে ফিরলেও পুঁজি ছিল না। ছোট ভাইটা নতুন করে খামার করার জন্য পুঁজি দিতে চেয়েছিল। ৩ আগস্ট ছোট ভাইকে ফোন দিই। বলল, “ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো হয়েছে। সবাই মাঠে নেমেছে। এখন ঘরে বসে থাকার সময় নয়। সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত ঘরে ফিরব না।” বাজার করার জন্য কিছু টাকা চাইলে বিকাশে তড়িঘড়ি করে টাকা পাঠিয়ে আন্দোলনে যায় সোহেল রানা।’
সিহাব উদ্দিন বলেন, ৫ আগস্ট বিকেলে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর শোনার পর বেলা তিনটার দিকে সোহেলকে ফোন দিয়েছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে একজন ফোন ধরেন। তিনি বলেন, সোহেল রানা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এ খবর শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ঢাকায় থাকা চাচাতো ভাই মিথুনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। সোহেল রানার লাশ নিয়ে তিনি বাড়িতে আসেন। লাশ পরিবহনের অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার ২৫ হাজার টাকা ধার করে শোধ দিতে হয়েছে।
গুলি লাগার বিষয়ে সিহাব জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। মৃত্যুসনদে ৫ আগস্ট বেলা পৌনে তিনটায় সোহেলের মৃত্যু হয় উল্লেখ করা হয়েছে। সোহেলের বুকে জাতীয় পতাকা ছাড়াও ছোট একটি ব্যাগ ছিল। গুলি ব্যাগ ভেদ করে তাঁর বুকে লেগেছে।
ভাই হত্যার মামলা করতে চান জানিয়ে শিহাব উদ্দিন বলেন, অভাবের সংসার। তিনবেলা ঠিকমতো খাবার জোটে না। ঢাকায় গিয়ে মামলা করার মতো সামর্থ্য নেই। আইনি সহায়তা পেলে গুলির নির্দেশদাতাসহ জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করতে চান।