বরগুনার বেতাগী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ফাহমিদা লস্করের এক ঠিকাদারের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। বুধবার দুপুরের দিকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে ওই কর্মকর্তার কার্যালয়ের ফার্মাসিস্টকে ঘুষের টাকা গুনে নিতে দেখা গেছে।
এ ঘটনায় জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন জেলা সিভিল সার্জন ফজলুল হক।
পথ্য ও স্টেশনারি সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি মো. রেজাউল ইসলাম ওরফে মামুন খান প্রথম আলোকে বলেন, তিন বছর ধরে বেতাগী হাসপাতালে খাবার (পথ্য ও স্টেশনারি) সরবরাহ করে আসছেন। বর্তমান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিল নিয়ে তাঁকে প্রায়ই হয়রানি করেন। মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দাবি করেন। দাবি অনুয়ায়ী জুন মাসে তাঁকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছেন।
ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে জানতে বেতাগী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ফাহমিদা লস্করের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। তবে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে মানসম্মত খাবার না পরিবেশনের অভিযোগ আছে। তিনি এ নিয়ে তাঁদের ডেকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। তিনি ঠিকাদারদের কাছ থেকে টাকা নেননি। তিনি বলেন, ‘মামুন সাহেব (রেজাউল) টাকা দিয়েছেন কি না, আমি তো জানি না। তা ছাড়া আমাকে তো ভিডিওতে টাকা গুনতে দেখা যাচ্ছে না। কৃষ্ণ (ফার্মাসিস্ট) টাকা গুনছেন, সেটা তো আমাদের অফিসের টাকাও হতে পারে।’
ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, রেজাউল ইসলাম উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কক্ষে প্রবেশ করছেন। পরে তাঁদের দুজনের মধ্যে কথোপকথন শোনা যায়। এ সময় রেজাউলের উদ্দেশে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘বিল কি উঠিয়েছেন, কবে? উত্তরে রেজাউল বলেন, ‘জি, বিল উঠিয়েছি, বুধবার।’ তখন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘রিয়াজ মোল্লা কই? সে আমার ঠিকাদার, আপনি তো আমার প্রধান ঠিকাদার না।’ জবাবে রেজাউল বলেন, ‘রিয়াজ মোল্লার মা অসুস্থ, আপনি তো জানেন, আমরা শেয়ারে আছি, তা ছাড়া সব কথাবার্তা তো আমিই বলি আপনি আসার পর থেকে। বৃহস্পতিবার আপনাকে ফোন দিয়েছি, কিন্তু আপনি রিসিভ করেননি।’
এরপর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘ফোন রিসিভ করিনি মানে? আমি সব সময়ই ব্যস্ত থাকি।’ জবাবে রেজাউল বলেন, ‘আমরাও তো ব্যস্ত থাকি, ঠিকাদারি করি। জুন মাসে আমাদেরও তো অন্যান্য চাপ থাকে। তা ছাড়া আপনি তো সেদিন ২১ তারিখ দেখা করতে বললেন, তাই আমি এখন এসেছি। ওইটা নিয়ে আসছি স্যার।’ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘সেটা আপনার আগে জানানো উচিত ছিল। আমার সাথে কথা বলা উচিত ছিল।’ জবাবে রেজাউল বলেন, ‘আপনার সাথে তো এসব বিষয়ে মোবাইলে কথা বলতে পারি না।’ এরপর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘মোবাইলে কেন বলবেন? আমাকে ইনফর্ম করতেন যে, স্যার আমি বিল পেয়েছি।’
ওই কথার প্রত্যুত্তরে রেজাউল বলেন, ‘আপনাকে ফোন দিয়েছি, ফোন ধরেননি দেখে আজ অফিসে আসলাম।’ এরপর খামে প্যাকেট করা টাকার বান্ডিল বের করেন রেজাউল। বলেন, ‘স্যার শুধু একটু মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে আর কিছুই না। আপনি রাগ কইরেন না।’ এ সময় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তাঁর ভাগে কত টাকা আসে জানতে চান। জবাবে রেজাউল বলেন, ‘আপনার আসে ৫৩ স্যার।’ এ সময় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তাঁর মোট কত টাকা আসে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্যার, আমি হিসাব করিনি। তবে জাকির সাহেব (হিসাবরক্ষক) বলেছেন, স্যারকে এটা দেবেন। বিল পেয়েই আপনাকে নক করেছি।’
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এরপর প্রধান ঠিকাদার রিয়াজ মোল্লাকে ফোন করে বলেন, ‘মামুন (রেজাউল) সাহেব তো এসেছেন, আমার কত ছিল যেন?’ কিছুক্ষণ কথোপকথনের পর তিনি ফোন রেখে দেন। কিছুক্ষণ পর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ফার্মাসিস্ট কৃষ্ণ কুমার পালকে ডাকেন এবং বলেন, ‘মামুন সাহেবের কাছ থেকে ওইটা গুনে আপনার কাছে রেখে দেন।’ এরপর অন্য আরেকটি বিলের ব্যাপারে তাঁদের কথা বলতে শোনা যায় ভিডিওতে।
বরগুনার সিভিল সার্জন ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে খাবার সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার ভিডিওটি তিনি দেখেছেন। বিষয়টি তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।