খুলনা জিলা স্কুলের পেছনের দিকে কেডি ঘোষ লিংক রোডের ফুটপাতেই চুল-দাড়ি কাটেন নির্মল শীল। গত রোববার তোলা
খুলনা জিলা স্কুলের পেছনের দিকে কেডি ঘোষ লিংক রোডের ফুটপাতেই চুল-দাড়ি কাটেন নির্মল শীল। গত রোববার তোলা

৫০ বছর ধরে কাজ করছেন নরসুন্দর নির্মল শীল, তবু জীবনের হিসাব মিলছে না

ঘড়িতে তখন দুপুর ১২টা ১০ মিনিট। তবে কুয়াশার ফাঁক গলে মাত্রই সূর্য উঁকি দিয়েছে। একটু একটু করে রোদ ছড়াতে শুরু করেছে। হিমেল বাতাসের কাছে নতজানু রোদের তেজ। ঠান্ডায় জবুথবু জনজীবন। এতে অবশ্য নির্মল শীলের দিনপঞ্জিতে কোনো হেরফের ঘটেনি। ‘জীবন-রসদ’ জোগাড় করতে রোজকার মতো কুয়াশাচ্ছন্ন সকালেই বের হয়েছেন ঘর থেকে।

নির্মল শীলের বয়স ৬৫ ছুঁয়েছে, শরীরে আগের মতো তাগদ নেই। কিন্তু তাঁর এক দিনও জিরানোর উপায় নেই। পেশায় তিনি নরসুন্দর। একসময় নিজের সেলুন ছিল, এখন খুলনা জিলা স্কুলের পেছনের দিকে কেডি ঘোষ লিংক রোডের ফুটপাতেই কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। মাথার ওপর আচ্ছাদন বলতে একটু টুকরা পলিথিন। উত্তরের কনকনে বাতাস সামাল দিতে ফুটপাতের প্রাচীরের ওপর টানানো হয়েছে সিমেন্টের খালি বস্তার পর্দা। পাশে বসার জন্য একটা বেঞ্চ। ফুটপাতের প্রাচীরের গায়ে চিকন আরেকটা বেঞ্চের ওপর রাখা বড় আয়না। আয়নার পাশে সেলুনের সরঞ্জাম। একজনের চুল কেটে দিচ্ছেন নির্মল। তাঁর ব্যস্ত হাতের কাঁচি চুলে ডুবছে আবার কাটাকুটির মধ্যে প্রয়োজনে চুলে চিরুনি বুলিয়ে নিচ্ছেন। পুরোনো কাঠের একটা ছোট চেয়ারে বসিয়েই চলছে এ কর্মযজ্ঞ।

নির্মল শীলের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়া ইউনিয়নের হরিদ্রা গ্রামে। জীবিকার সন্ধানে ১৯৭৫ সালে খুলনায় আসেন। বেছে নেন বংশপরম্পরার নরসুন্দরের পেশা। এরপর জীবনে নানা রকম ছন্দ পতন হয়েছে, তবে ৫০ বছর ধরে এই কাজই করে যাচ্ছেন।

গত রোববার দুপুরে ফুটপাতের সেলুনের পাশে দাঁড়িয়েই কথা হচ্ছিল নির্মল শীলের সঙ্গে। নির্মল বলেন, ‘আর্থিক সংকটের কারণে পড়াশোনা হয়নি। বয়স যখন ১০, তখন মুক্তিযুদ্ধ হয়। কাজের উদ্দেশ্যে খুলনা আসি। বয়স তখন ১৪ থেকে ১৫ বছর। দাদার শ্যালক এখানকার ১ নম্বর কাস্টমঘাট এলাকায় সেলুনের কাজ করতেন। সেখানেই এসে উঠি। তখন চুল কাটা ১২ আনা বা এক টাকা; শেভ হওয়া আট আনা। নোয়াখালী-চাঁদপুরের লোক যাঁরা খুলনায় থাকতেন, তাঁরা একটু বেশি দিতেন। দিনে ১২ থেকে ১৩ টাকা রোজগার হতো তখন।’

বছর চারেক পর নিজেই সেলুনের দোকান দেন নির্মল শীল। নগরের নতুন বাজার এলাকায় ছিল সেই দোকান। সেখানে তাঁর সেলুনে অন্যরাও কাজ করতেন। এর কয়েক বছর পর ঢাকায় চলে যান তিনি। ঢাকাতেও বছর চারেক নরসুন্দরের কাজ করেন। আবার ফিরে আসেন খুলনায়।

জীবিকার সন্ধানে ১৯৭৫ সালে খুলনা আসেন নির্মল সেন। বেছে নেন বংশপরম্পরার নরসুন্দরের পেশা। ৫০ বছর ধরে এই কাজই করে যাচ্ছেন

২০ বছর ধরে খুলনা জিলা স্কুলের পেছনে ফুটপাতের নালার ওপর টিনের ছাউনির টংঘর করে সেলুন চালাতেন নির্মল শীল। গত বছর সিটি করপোরেশনের নালা সংস্কারের সময় তাঁর ঘরটি ভাঙতে হয়েছে। এরপর সোজা ফুটপাতে এসে পড়েন। জীবিকার জন্য প্রতিদিন খুব সকালে এখানে আসেন। আলো না থাকায় বিকেলের পর আর কাজ করা সম্ভব হয় না। এখন চুলকাটায় তিনি রাখেন ৫০ থেকে ৬০ টাকা; দাড়ি কামানো ৩০ টাকা। কাজ শেষে চেয়ার-বেঞ্চ-টেবিল একসঙ্গে তালা লাগিয়ে রেখে যান। আয়নাটা সঙ্গে করে নিয়ে যান বাসায়।

নির্মল শীল বলেন, সেলুন থাকতে আয়রোজগার মন্দ ছিল না। প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা হতো। এখন বিকেলের পর আর কাজ করা যায় না। আয় অনেক কমে গেছে। পরিচিত মানুষেরাই এখন বেশি আসেন। তারপরও কাস্টমার খুব কম হয়। কাজে ভাটা। আধুনিক যুগ; সবখানেই বিলাসিতা। এখন সবাই ভালো সেলুনে যায়। মানুষ এখন খোলা জায়গায় চুল কাটাতে চায় না।

নির্মলের অস্থায়ী সেলুনের পাশে থাকা বেঞ্চে বসে স্থানীয় পত্রিকা পড়ছিলেন দুজন। তাঁদের একজন শংকর মজুমদার বলেন, ‘নির্মল দা ভালো মনের মানুষ, সুযোগ পাইলে এখানে আসি, পত্রিকা পড়ি। অনেকেই আসে। এখানে চুল-দাড়ি কাটার খরচ কিছুটা কম। আর চুল-দাড়ি কাটায় দাদার হাত বেশ ভালো।’

জীবন মানেই তো কষ্ট। এখন আর কোনো ভালো লাগা, খারাপ লাগা নেই। যা সৃষ্টিকর্তা করবে, তা–ই হবে। কপালের ওপর তো কারও হাত নাই।
নির্মল শীল, নরসুন্দর

নির্মল শীলের তিন মেয়ে। দুই মেয়ের মাস্টার্স শেষ হয়েছে। অন্যজন স্নাতকে (সম্মান) পড়েন। তিন মেয়েরই বিয়ে হয়েছে। এখন তিনি স্ত্রীকে নিয়ে পুলিশ লাইনস এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন।

সংসারের কথা বলতে বলতে জীবনের নানা হিসাব-নিকাশের আলাপ তোলেন নির্মল। তাঁদের জীবনটাই তো অঙ্কনির্ভর। লবণ-ভাত জোগানের হিসাব কষতে কষতে জীবন পার করেন, তবু পরের দিন পাতে কী পড়বে, তা নিয়ে হিসাব মেলানো কঠিন হয়। অনেক সময় নিজেকে সঁপে দেন ভাগ্যের হাতে। ভীষণ হতাশা নিয়ে তিনি বলেন, ‘দোকানটা নেই। নতুন করে আর করাও হবে না। খাওয়াই চলে না, আবার জায়গা বা দোকান কিনব কী করে? তারপরও না চললেও তো চালাইতে হয়। জীবন মানেই তো কষ্ট। এখন আর কোনো ভালো লাগা, খারাপ লাগা নেই। যা সৃষ্টিকর্তা করবে, তা–ই হবে। কপালের ওপর তো কারও হাত নাই।’