সারা গ্রামের সড়ক ও অলিগলিতে অসংখ্য মানুষ। ভিড় গিয়ে ঠেকেছে কলেজছাত্র সিবলী সাদিকদের বাড়িতে। অপহরণের ১৪ দিনের মাথায় গতকাল সোমবার তাঁর দেহাবশেষ উদ্ধারের পর থেকেই বাড়িতে আসছেন আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী আর গ্রামের মানুষ। আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে বাড়ির সামনে যেতেই শোনা গেল কান্নার শব্দ। বাড়ির একটি কক্ষের ভেতর থেকে আসছিল মা নাহিদা আকতারের আহাজারি। একটু পরেই তা থেমে গেল। ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছেন তিনি। তাকে ঘিরে থাকা নারীদের চোখেও তখন অশ্রু ঝরছিল।
সিবলি সাদিকের (১৯) বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানের কদলপুর ইউনিয়নের পঞ্চ পাড়ায়। গতকাল সকালে বাড়ি থেকে আট কিলোমিটার দূরে রাঙামাটি উপজেলার কাউখালী ইউনিয়নের দুর্গম বালু পাহাড় থেকে তাঁর দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। সেখানে দেহাংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। এ সময় পুলিশের সঙ্গে যাওয়া সিবলীর পরিবারের সদস্যরা পরনের প্যান্ট ও গেঞ্জি দেখে দেহাবশেষ শনাক্ত করেন। গত ২৮ আগস্ট বাড়ির ২০০ ফুট দূরত্বের একটি মুরগি খামার থেকে অপহরণ করা হয় সিবলীকে।
আজ সকালে বাড়িতে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে পাওয়া গেল সিবলীর ফুপু বেবী আকতারকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুই ছেলের মধ্যে বড় সিবলীকে নিয়ে মা–বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। ছেলেও সব সময় বাবার সংসারে সহযোগী হয়ে চাইতেন হাল ধরার। এ জন্য কলেজে পড়ার পাশাপাশি স্থানীয় একটি খামারে ব্যবস্থাপকের চাকরি নেয়। সেই খামারের শ্রমিকেরাই তাঁকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের পর কেটে টুকরা টুকরা করে পাহাড়ের গহিনে ফেলে এল।
বেবী আকতারের কথার মধ্যেই সিবলীর মা নাহিদা আকতার আহাজারি করতে করতে বললেন, ‘আরে ইতেরা ফোন গেরিয়েরে পইল্লে ১৫ লাখ ট্যায়া তুয়াইয়্যে (আমাকে ফোন করে প্রথমে ফোন করে ১৫ লাখ টাকা চায়)। আর ফোন নগরে (আর ফোন করেনি)। দুই দিন পর আবার ফোন গরি। ট্যায়া তুয়াইলি আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরা হই হই চাঁদা তুলি দুই লাখ টিয়া দি আইসসিলাম। ত কিল্লেই আর পোয়ারে টুরো টুরো গইল্লু হছুনারে (তবু কেন আমার ছেলেকে মেরে টুকরা করল আমাকে বলেন)।’
বাড়ির আরেক কক্ষের মেঝেতে অচেতন হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেল সিবলীর বাবা মুহাম্মদ শফিকে (৪৫)। কয়েকজন মিলে তাঁকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস দিচ্ছেন। মুখে লেবুর রস খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। তবে ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করলেও তাঁর জ্ঞান ফেরেননি। প্রতিবেশীরা জানালেন, সিবলীর দেহাবশেষ উদ্ধারের পর থেকেই মা–বাবা কখনো আহাজারি করছেন, কখনো অচেতন হয়ে পড়ছেন।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অপহরণের ২ দিন পর ৩০ আগস্ট একটি নম্বর থেকে অপহরণকারীরা মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দেয় কলেজছাত্র সিবলী সাদিকের। তখন ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন অপহরণকারীরা। পরে সাড়া না পেয়ে গত ৩১ আগস্ট আবার ফোন করে ২ লাখ টাকা চান তাঁরা। পরদিন ১ সেপ্টেম্বর শিবলীর বাবা ২ লাখ টাকা নিয়ে বান্দরবান জেলা সদরের পূর্বনির্ধারিত জায়গায় গিয়ে দুজন লোকের হাতে টাকা তুলে দেন। তাঁদের বলা হয় ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি চলে যাবে। কিন্তু সিবলী আর ফেরেননি। তাঁর সঙ্গে সর্বশেষ ৩১ আগস্ট মুঠোফোনে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলিয়ে দেয় অপহরণকারীরা। পরিবারের ধারণা, এরপরই তাঁকে মেরে টুকরা টুকরা করে পাহাড়ে ফেলে দেওয়া হয়।
সিবলী কদলপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। অপহরণের ঘটনার পরদিন মামলা করতে চাইলেও রাউজান থানা-পুলিশ নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন বলে অভিযোগ পরিবারের। পরে ঘটনার আট দিন পরে গত বুধবার রাতে অপহরণ মামলা রেকর্ড করা হয়। মামলায় যে ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে তাঁরা সবাই সেই মুরগির খামারের শ্রমিক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। গতকাল এক আসামিকে নিয়ে সিবলীর দেহাবশেষ উদ্ধার করতে গিয়েছিল পুলিশ। ফেরার পথে উমং চিং মারমা (২৬) নামের ওই আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন বিক্ষুব্ধ জনতা।
কদলপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ওমর ফারুক আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, সিবলী পড়ালেখার খরচ চালাতেই খামারে চাকরি নিয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষা নেওয়ার। কিন্তু তাঁকে সহকর্মীরা নির্মমভাবে হত্যা করল তাতে পুরো কলজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভেঙে পড়েছে। তাঁরা এই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চান, যেন এমন নৃশংসতার শিকার আর কেউ না হন।