কোথাও হামলা, ভাঙচুর কিংবা অঘটন হলেই মানুষ সহায়তা চান কিংবা ছুটে যান স্থানীয় থানায়। কিন্তু সেই থানাতেই হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটল। চট্টগ্রাম নগরের অন্তত আট থানা ও ভবন এখন পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।
পুড়ে গেছে থানার সামনে থাকা পুলিশে পিকআপ, জিপ গাড়ি। ভেতরে ছাই হয়ে গেছে বেশির ভাগ আসবাব ও জরুরি কাগজপত্র। ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে কাচ। বাদ যায়নি টয়লেটের কমোড, বেসিনও।
পোড়া গন্ধে থানা ভবনগুলোতে ঢুকতেই দম আটকে আসছে। থানায় আগুন, হামলা থেকে বাঁচতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) থেকে শুরু করেছে সব পুলিশ সদস্য। আজ মঙ্গলবার দুপুরে গিয়েও দেখা গেছে, সব কটি থানা ভবন শূন্য। সেখানে দাঁড়ানোর সুযোগও নেই।
গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকায় খণ্ড খণ্ড মিছিল বের করেন মানুষ। এর মধ্যে বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে দুষ্কৃতকারীরা অগ্নিসংযোগ, হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এতে নগরের কোতোয়ালি, সদরঘাট, ডবলমুরিং, পাহাড়তলী, আকবর শাহ, ইপিজেড, পতেঙ্গা ও হালিশহর থানা ভবন ধ্বংসস্তূপ হয়ে যায়। এরপর রাতভর চলে থানার ভেতরে থানা-পুলিশের সদস্যদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ল্যাপটপসহ নানা জিনিস লুটপাট। তবে কী পরিমাণ অস্ত্র ও সম্পদ লুট হয়েছে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না পুলিশ কর্মকর্তারা। থানায় গিয়ে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের সুযোগ পাচ্ছেন না তাঁরা।
নগরের ব্যস্ততম কোতোয়ালি মোড়। সেখানেই কোতোয়ালি থানা ভবন। সড়ক থেকে চোখ পড়ছে থানা ভবন। থানার সামনে আগুন ভস্মীভূত সাঁজোয়া যান এর পাশে চারটি পিকআপ আগুনে পুড়ে সাদা হয়ে আছে। আরেকটু দূরে ছয়টি কার মাইক্রোবাস, চারটি মোটরসাইকেলেরও একই অবস্থা।
থানায় ঢুকতেই হাতের বাঁ পাশে ছিল অভ্যর্থনা কক্ষ (ডিউটি অফিসারের কক্ষ) সেটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে কালো হয়ে আছে ছাদের পলেস্তারা। এমনকি আগুনে বাঁকা হয়ে গেছে সিলিং ফ্যান। আরেক পাশে ওসি কক্ষটির কাচ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আগুন দেওয়া হয়েছে হাজতখানাতেও।
থানা ভবনের দোতলায় উঠতেই এসআই ও এএসআইদের বসার কক্ষ। পুরো কক্ষটিতে ভাঙা কাচ ও চেয়ার–টেবিল। মামলার তদন্তের বিভিন্ন কাগজপত্র ও নথি যাঁর যাঁর টেবিলের ড্রয়ারে রাখতেন। কিন্তু সব কাগজপত্র তছনছ হয়ে গেছে। তৃতীয় তলায় থাকেন এসআই ও পুলিশের সদস্যরা। সেখানে তাঁদের জিনিসপত্র ও খাট ভেঙে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে আছে। লুট হয়েছে জিনিসপত্র।
গতকাল থানায় হামলার পর অনেক পুলিশ সদস্য বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলে আটকে ছিলেন ১০ পুলিশ সদস্য। পরে তাঁদের থানায় এসে বের করে নেন নগর বিএনপির সাবেক সদস্যসচিব আবুল হাশেম ও যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল মান্নান। আবুল হাশেম ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সন্ধ্যার দিকে নগর পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ফোন পেয়ে বিএনপির লোকজন নিয়ে কোতোয়ালি থানার কার্যালয়ে যান। সেখানে গিয়ে দেখি, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ভেতরে অনেক লোক। তাঁদের সরিয়ে আটকে থাকা নারীসহ ১০ পুলিশ সদস্যকে থানা থেকে বের করে নিয়ে আসি। আর কিছুক্ষণ থাকলে তাঁরা আগুনে পুড়ে মারা যেতেন। পরে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া হয়। তারা থানার ভেতরে প্রচুর লোকজনের ভিড় রয়েছে খবর পেয়ে নিরাপত্তার জন্য অপারগতা জানায়। তাদের আশ্বস্ত করা হলে রাত আটটার দিকে ফায়ার সার্ভিস এসে কোতোয়ালি থানা ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।’
কোতোয়ালির মতো অবস্থা পাহাড়তলী থানায়ও। থানার সামনে থাকা গাড়িগুলো আগুনে পুড়ে যায়। চারতলা থানা ভবনের ওসি, পরিদর্শক (তদন্ত), ডিউটি অফিসারের কক্ষসহ সব আসবাব ভেঙে ফেলা হয়েছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আশপাশে। পতেঙ্গা থানা ভবনের সামনে থাকা গাড়ি, ওসির কক্ষেও আগুনে পুড়ে গেছে। হালিশহর থানায় গাড়িতে আগুন, ভাঙচুর ও পুরো থানা ভবনে চালানো হয়েছে তাণ্ডব।
হালিশহর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুজাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, থানায় প্রচুর লোক হামলা করতে আসছেন খবর পেয়ে পুলিশ তাঁদের প্রতিরোধের চেষ্টা করে। পরে থানায় থাকা পুলিশ সদস্যরা নিজের প্রাণ রক্ষা করেন। হামলাকারীরা পুরো থানা ভবনে আগুন, হামলা, ভাঙচুর চালিয়ে শেষ করে দিয়েছেন। থানায় থাকা তাঁর ল্যাপটপ, তদন্তাধীন মামলার গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রসহ প্রায় চার লাখ টাকার তাঁর ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নিয়ে গেছেন। একই অবস্থা থানার অন্য কর্মকর্তাদেরও।
নগরের সদরঘাট থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানার প্রধান ফটকের সামনে স্তূপ হয়ে আছে বিভিন্ন মামলার আলামত। ভেতরে ঢুকতেই পুলিশের চারটি গাড়ি ভেঙে চুরমার হয়ে আছে। বেশ কিছু লোকজনকে দেখা গেছে জিনিসপত্র নিয়ে যেতে। ডবলমুরিং থানার সামনেও পাঁচটি গাড়ি ভাঙচুর করা অবস্থায় দেখা গেছে। পুরো থানা ভবনের সব কটি কক্ষ ভাঙচুর হয়েছে। গতকাল রাত থেকে লুটপাট হওয়ায় আজ দুপুর থেকে থানার মূল ফটকে চেয়ার-টেবিল দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। যাতে কেউ সহজে ঢুকে লুটপাট করতে না পারে। নগরের আকবর শাহ থানার সামনে থাকা পুলিশের গাড়ি ও ভেতরে ভাঙচুর চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ভাঙচুর হয়েছে ইপিজেড থানাও।
এদিকে নগরের মইজ্জারটেকসহ মোড়ে মোড়ে থাকা সব পুলিশ বক্স ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। নগরের সদরঘাটে অবস্থিত ট্রাফিক পুলিশের ডাম্পিংয়ে থাকা মোটরসাইকেল, কার, সিএনজি অটোরিকশাসহ গাড়ি লুটপাট হয়েছে। তবে সংখ্যা জানা যায়নি।
নগরের কোতোয়ালি থানার সামনে বিক্ষোভ করতে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে গতকাল কথা হয় প্রথম আলোর। কেন থানায় হামলা চালাতে এসেছেন, জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, গায়েবি মামলায় পুলিশ তাঁদের ধরেছে। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করেছে। জামিনে থাকলেও অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছে। শান্তিতে বেশির ভাগ রাত বাসায় থাকতে পারেননি।
মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, তাঁদের ওপর (ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) থেকে যেভাবে বলা হয়েছে, সেভাবে কাজ করেছেন। তাঁরা শুধু আদেশ পালন করেছেন। আর এখন হামলার শিকার হচ্ছেন। তবে পুলিশকে কোনো রাজনৈতিক দল যাতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, সেই দাবি মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) কাজী তারেক আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, কিছু থানায় হামলা হয়েছে। আর বেশি কিছু বলার মতো অবস্থা নেই।