কুয়াশাচ্ছন্ন হেমন্তের রাত। ঘড়ির কাটা ১২টা পার হতেই পাল্টে গেছে বাণিজ্যনগরী নারায়ণগঞ্জের চিত্র। শুনশান সড়কে বেওয়ারিশ কুকুরগুলোর দাপট। যেসব দোকানিরা বাড়তি আয়ের আশায় বসে ছিলেন, তাঁরাও এবার বাড়ি ফিরছেন। আবুল কালাম আজাদ (৫২) তাঁদের মধ্যে ব্যতিক্রম। কাঠের টেবিলে রাখা ছোট ছোট বালতিতে ভেজানো বাহারি রঙের গোলাপ, ঝোলানো গাজরা আর রজনীগন্ধার মালা নিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।
গতকাল শনিবার মধ্যরাতে নারায়ণগঞ্জ নগরের শেখ রাসেল পার্কের সামনে আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে দেখা। এত রাতে ফুল নিয়ে বসে থাকার কারণ জানতে চাইলে একগাল হেসে জবাব দেন, ‘ফুলগুলারে ফুটতে দিতাছি।’ আলাপে জানা গেল কথার মর্ম। গত বৃহস্পতিবার ঢাকার শাহবাগ থেকে গোলাপের কলি কিনে এনেছেন। সেগুলোর মধ্যে যেসব গোলাপের পসরা সাজিয়ে গতকাল পার্কের সামনে বসেছেন, তার সব কটি বিক্রি হয়নি। রাতে দোকান বন্ধ করতে গিয়ে দেখলেন বালতির পানিতে ভেজানো তিনটে গোলাপের কলি তখন অর্ধেক ফুটেছে। এমন অবস্থায় ফুলগুলো পানি থেকে তুলে নিলে রাতে আর ফোটার সুযোগ হবে না। উল্টো গোলাপ তিনটি নষ্ট হওয়ার শঙ্কা আছে।
আজাদ মনে করেন, কলি অবস্থায় ফুল ফ্রিজে রাখলে ভালো থাকে। সেসব কলি বের করে এনে পানিতে ভিজিয়ে রাখলে ফুটতে শুরু করে। অবিক্রিত ফুল বিশেষ ধরনের পলিথিনে মুড়িয়ে আবার ফ্রিজে রাখেন তিনি। তবে সে ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হয়, কোনো পাপড়ি পুরোপুরি ফোটার আগে সেই ফুল যেন পানি থেকে না তোলা হয়। তাতে ফুলটি দ্রুতই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সেই সতর্কতা থেকেই হিমের রাতে গোলাপ ফোটার অপেক্ষায় তিনি।
তিন বছরের পর্যবেক্ষণে আজাদ এই বিদ্যা অর্জন করেছেন বলে জানালেন। যখন প্রথম ফুলের ব্যবসায় আসেন, তখন প্রতিদিনই ফুল নষ্ট হতো। দিনের পর দিন পর্যবেক্ষণ আর রাজধানীর শাহবাগে ফুলের দোকানে বসে থেকে শিখেছেন ‘কেমন যত্নে ফুল হাসে।’
পার্কের পাশেই দেওভোগ এলাকায় আজাদের বাপ-দাদার ভিটা। বাবা নান্নু ব্যাপারী ছিলেন দিগুবাবুর বাজারের কাঁচামালের আড়তদার। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় আজাদ রাজনীতিতে জড়িয়ে বিদ্যালয় ছাড়েন। রাজনৈতিক ক্যাডার থেকে একসময় তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিকের কাজ নেন। করেছেন শ্রমিক রাজনীতি। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর শুরু করা ঝুট ব্যবসা রাজনৈতিক বিরোধের কারণে হাতছাড়া হয় বিগত সরকারের আমলে। উপার্জনের জন্য ছয় বছর আগে শহরের ফুটপাতে শিশুদের খেলনা বিক্রি শুরু করেন। বেশি মুনাফার সম্ভাবনা দেখে তিন বছর আগে শুরু করেন ফুল বেচাকেনার ব্যবসা।
আজাদের ভাষ্য, ১ হাজার ৭০০ টাকা পুঁজিতে ফুলের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। রাজধানীর শাহবাগ, আগারগাঁও ও নারায়ণগঞ্জ থেকে ফুল সংগ্রহ করেন। গড়ে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার টাকার ফুল নিয়ে বসেন। সেসব ফুল বিক্রি হয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায়। ছুটির দিনে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার ফুল বিক্রি হয়। বিশেষ দিনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এতে তাঁর প্রতি মাসে ৩৫ হাজার টাকার মতো আয় হয়। এই আয়ে সুন্দরভাবেই সংসার চলে তাঁর।
আজাদ যখন দোকান গুটিয়ে নিচ্ছেন, তখন হোসিয়ারি কারখানার শ্রমিক মো. সাকিব (২৪) আসেন ফুল কিনতে। ৩০ টাকায় দুটি গোলাপ কেনেন তিনি। সাকিব জানালেন, কাজ শেষে বাড়ি ফিরছেন। বাসায় খাবার নিয়ে অপেক্ষায় আছেন স্ত্রী। চার বছরের বিবাহিত জীবন তাঁদের। সুযোগ পেলেই স্ত্রীর জন্য ফুল কেনেন। তাতে ভীষণ খুশি হন স্ত্রী।
ফুল বেচাকেনার তিন বছরের অভিজ্ঞতায় কিছু কথা বলেন আজাদ। তাঁর ভাষ্য, তাঁর কাছ থেকে ধনীর তুলনায় দরিদ্ররা বেশি ফুল কেনেন। বিবাহিতদের চেয়ে অবিবাহিত তরুণ-তরুণীরা ফুল বেশি কেনেন। কেউ ফুলের দরদাম করে টাকার অভাবে ফিরে গেলে তাঁর খারাপ লাগে। তখন তিনি ফুলের দাম কম রাখেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমি চাই সব মানুষের ফুল কেনার সামর্থ্য হোক।’