‘বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, যত দোষ, নন্দ ঘোষ। বিষয়টি এমনই যে সবকিছুর জন্য একজনকে দায়ী করা। আমরাও যেন তেমন বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে দায়ী করছি ওই নন্দ ঘোষকে। এখানে নন্দ ঘোষ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির জন্য আমাদের অবদানও যে কম নয়, তা আমরা একেবারে এড়িয়ে যাচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তনকে সবকিছুর জন্য দায়ী করে নিজেদের দায় সহজে অস্বীকার করা যায়।’
আজ সোমবার খুলনার কয়রা উপজেলা পরিষদের মিলনায়তনে ‘জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগঝুঁকি হ্রাস, অভ্যন্তরীণ মাইগ্রেশন’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা এ কথা বলেন। তিনি এই গোলটেবিল বৈঠকের একজন আলোচক ছিলেন। বেলা ১১টায় শুরু এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুলী বিশ্বাস। অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করেছে বেসরকারি সংস্থা কারিতাস।
বৈঠকে বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, ‘বৃষ্টি, ঝড়, বন্যা—এগুলো প্রাকৃতিক। বলাই বাহুল্য যে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। কিন্তু আমরা তো বন্যা ঠেকানোর জন্য বাঁধ দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই বাঁধ আমরা যত্রতত্র কেটে ও ছিদ্র করে পাইপ দিয়ে নোনাপানি উঠিয়ে চিংড়িঘের করেছি। দুর্বল বাঁধ আমাদের রক্ষা করতে না পেরে গোটা এলাকা বারবার ডুবিয়ে দিয়েছে। দুর্যোগে এসব ক্ষতির দায় কি আমরা এড়াতে পারি?’ তিনি বলেন, ‘দুর্যোগগ্রস্ত, উপায়হীন মানুষ এলাকা ছাড়ছেন। অবশ্যই ঘূর্ণিঝড়ের এই দাপট জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু তাই বলে নোনাপানি টেনে চিংড়ি চাষ করার জন্য আমরা যে বাঁধগুলো যথেচ্ছভাবে কেটেছিঁড়ে একেবারে দুর্বল করে দিলাম, আর সেই দুর্বল বাঁধে জলোচ্ছ্বাসের সামান্য ধাক্কায় সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেল—এই বিষয়টি আমরা বিবেচনাতেই আনলাম না। সব দোষ ওই জলবায়ু পরিবর্তনের। অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আমরা নিজেদের দায় এড়িয়ে গেলাম।’
বৈঠকে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক ইসমাইল হোসেন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাবের ওপর তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মূলত দায়ী মানুষ। মানুষের কারণে সব প্রাণী, জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বনভূমি উজাড়, কলকারখানা, যানবাহন ইত্যাদি বেড়ে গিয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘পরিবেশের বিপর্যয় ঠেকাতে হলে আমাদেরকে বেশি করে গাছ লাগাতে হবে।’
সভায় উন্মুক্ত আলোচনায় পরামর্শ তুলে ধরে বক্তারা বলেন, অভ্যন্তরীণ অভিবাসন কমাতে টেকসই বেড়িবাঁধসহ পরিকল্পিত উন্নয়ন করা আবশ্যক। বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন বাড়াতে হবে, খাদ্য ও পানির অপচয় রোধ করা, প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার কমানো, জমিতে জৈব সার ব্যবহার, কার্বন ডাই–অক্সাইড, মিথেনের মতো অতি দূষণকারী গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করা। তাহলে দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানো সম্ভব।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ইউএনও রুলী বিশ্বাস বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন দুর্যোগের মাত্রা প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। নদ-নদীতে পলি জমার কারণে উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে নদী উপচে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। ফলে মানুষ সহায়-সম্বলহীন হয়ে অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা দরকার। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের অনুষ্ঠান এই উপজেলার জন্য প্রথম। তাই আজকের অনুষ্ঠানের আপনাদের সুচিন্তিত মতামত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করব, যাতে আগামী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বৈঠকে কয়রা উপজেলার সরকারি দপ্তরের বিভিন্ন কর্মকর্তা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি, স্থানীয় অভিবাসন ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।