কৃষক দল নেতার ফেস্টুনে সংসদীয় আসনের নাম, ফরিদপুর বিএনপিতে আবারও বিভক্তি

কৃষক দলের কেন্দ্রীয় নেতা আলমগীর কবিরের পক্ষে টানানো ফেস্টুনকে কেন্দ্র করে ফরিদপুর বিএনপিতে বিভক্তি প্রকট হয়ে উঠেছে। আজ সকালে ফরিদপুর শহরের ব্রহ্মসমাজ সড়কে
ছবি: প্রথম আলো

চার–পাঁচ দিন ধরে ফরিদপুর শহরের অলিগলিতে একটি ফেস্টুন দেখা যাচ্ছে। কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক আলমগীর কবিরের নামে এ ফেস্টুন টানানো হয়েছে বিএনপির ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে। তবে ফেস্টুনের প্রচারক হিসেবে ‘ফরিদপুর-৩ আসনের সর্বস্তরের জনগণ’ উল্লেখ থাকায় দেখা দিয়েছে বিপত্তি।

১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হলেও ফরিদপুরে দিবসটি উদ্‌যাপিত হয়েছে গতকাল রোববার (৩ সেপ্টেম্বর)। অবশ্য সেখানে দেখা গেছে বিভক্তি। বিএনপির নেতা-কর্মীরা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে এই কর্মসূচি পালন করেন। বিএনপির নেতারা বলছেন, নতুন টানানো ফেস্টুন ঘিরে ফরিদপুর বিএনপির বিভক্তি প্রকট হয়ে উঠেছে। ফেস্টুনে সংসদীয় আসনের উল্লেখ থাকায় অন্য নেতারা মনে করছেন, ফরিদপুর–৩ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন চাইতে পারেন কৃষক দল নেতা আলমগীর কবির। এতেই চটেছেন অন্য পক্ষের নেতারা।

ফরিদপুরে এই প্রথম আলমগীর কবিরের নামে ফেস্টুন টানাতে দেখা গেল। তাঁর বাড়ি চরভদ্রাসনে। তিনি ফরিদপুরের সাধারণ মানুষের কাছে ‘অচেনা’ একটি নাম। তিনি আমেরিকার ফ্লোরিডায় বসবাস করেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা বিএনপির দুই নেতা বলেন, আলমগীর কবির কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক ও ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার বাসিন্দা শহীদুল ইসলামের ব্যবসায়িক সহযোগী। অচেনা আলমগীর কৃষক দলের পদটিও পেয়েছেন শহীদুল ইসলামের বদন্যতায়। আলমগীর কবিরের ফেস্টুনেও শহীদুল ইসলামের ছবি গুরুত্ব পেয়েছে।

ফরিদপুর জেলা ও মহানগর বিএনপির আহ্বায়কের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শোভাযাত্রা। রোববার বিকেলে

গতকাল ফরিদপুর জেলা ও মহানগর বিএনপির ব্যানারে আয়োজিত কর্মসূচিতে অংশ নেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এ এম এম কাইউম, জেলা বিএনপির সদস্যসচিব এ কে কিবরিয়া, কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার মাশুকুর রহমান, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শাহ মো. আবু জাফর, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ মোদাররেছ আলী ওরফে ইছাসহ অন্যরা। অন্যদিকে ফরিদপুর মহানগর বিএনপির ব্যানারে আরেকটি কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন কেন্দ্রীয় মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক চৌধুরী নায়াব ইউসুফ। তিনি সাবেক মন্ত্রী ও ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের মেয়ে। জেলা বিএনপির দুই যুগ্ম আহ্বায়ক আফজাল হোসেন খান ও জুলফিকার হোসেনের নেতৃত্বে পৃথক আরেকটি মিছিল হয়।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের নভেম্বরে ফরিদপুরে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের আগপর্যন্ত দলের কর্মসূচি বিভক্তভাবে পালিত হয়েছে। তবে ওই সমাবেশ ঘিরে এক হন সবপক্ষের নেতা–কর্মীরা। এর পর থেকে সবপক্ষকে একসঙ্গে দলীয় কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে। গতকাল প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি ঘিরে আবারও বিভক্তি সামনে এল।

ফরিদপুরে কেন্দ্রীয় মহিলা দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নায়াব ইউসুফের নেতৃত্বে শোভাযাত্রা। রোববার বিকেলে
দলের ভেতর ঘাপটি মারা একটি গোষ্ঠী বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে অজানা–অচেনা এক লোককে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। তারা প্রকারন্তরে দলেরও ক্ষতি করছে।
নায়াব ইউসুফ, কেন্দ্রীয় মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক

ফরিদপুরে বিএনপির রাজনীতিতে দুটি ধারা শুরু থেকেই বর্তমান ছিল। একটি ধারার নেতৃত্ব দিতেন বিএনপির মহাসচিব প্রয়াত কে এম ওবায়দুর রহমান এবং অপর ধারার নেতৃত ছিলেন চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ। পরে এই দুই নেতার মেয়ে শামা ওবায়েদ ও নায়াব ইউসুফ দুটি ধারার নেতৃত্বে আসেন। শহীদুল ইসলাম বরাবরই কামাল ইউসুফের বলয় বজায় রাখতেন। সম্প্রতি জেলা আহ্বায়ক কমিটিতে কৃষক দল নেতা শহীদুল ইসলামের গুরুত্ব বাড়ছে বলে মনে করছেন জেলা বিএনপির নেতারা।

ফরিদপুর-৩ সংসদীয় আসনটি থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ। তিনি প্রয়াত হওয়ার পর রাজনীতির মাঠে পা দিয়েছেন মেয়ে নায়াব ইউসুফ। বাবার উত্তরসূরি হিসেবে ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনে নির্বাচন করার ইচ্ছাও রয়েছে তাঁর।

দলে বিভক্তির বিষয়ে নায়াব ইউসুফ বলেন, ‘ফরিদপুর-৩ আসনে বিএনপি প্রতিষ্ঠা আমার বাবা-দাদারই করেছেন। এ আসনটি বিএনপি থেকে ছাড়িয়ে নিতে নানা ষড়যন্ত্র চলছে। দলের ভেতর ঘাপটি মারা একটি গোষ্ঠী বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে অজানা–অচেনা এক লোককে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। তারা প্রকারন্তরে দলেরও ক্ষতি করছে। তাঁর নাকি (আলমগীর কবীর) অনেক টাকা। এসব টাকার খেলা।’

জেলা বিএনপি একটি অঙ্গসংগঠনের (কৃষক দল) মধ্যে ঢুকে গেছে বলে অভিযোগ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জুলফিকার হোসেনের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অঙ্গসংগঠনের নিয়ন্ত্রণে বর্তমান আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব পরিচালিত হচ্ছেন। এ কারণেই দলের মধ্যে হঠাৎ করে এ বিরোধ চাঙা দিয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, সর্বশেষ কৃষক দলের আলমগীর কবিরের বিলবোর্ড সংসদীয় আসন যুক্ত করায় এ দ্বন্দ্ব প্রকট হয়। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে গতকালের কর্মসূচিতে।

উনি ফেস্টুন দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোয় দোষের কিছু দেখি না। তবে উনি ফরিদপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচন করবেন এ চিন্তা আমি করি না। বড় দলে একটি আসনে চার–পাঁচজন মনোনয়ন চাইতে পারেন।
শহীদুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক

জেলা বিএনপিকে একটি অঙ্গসংগঠন গিলে ফেলেছে—এ অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই বলে দাবি জেলা বিএনপির সদস্যসচিব এ কে কিবরিয়ার। তিনি বলেন, ‘আমাদের সবার লক্ষ্য এক দফার আন্দোলন সফল করে দেশে তারেক রহমানের নেতৃত্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। ফেস্টুন যে কেউ টানাতে পারেন। কারও টানানো বিলবোর্ড দেখে কেউ যদি ভয় পেয়ে যান, তা গ্রহণীয় হতে পারে না। এ কে কিবরিয়া আরও বলেন, ‘উনি (নায়াব) কেন অস্থির হবেন? শহরের কমলাপুর স্বার্থবাদী মহল্লার একটি অংশ নায়াব ইউসুফকে কুক্ষিগত করে রাখতে চান।’

কৃষক দল জেলা বিএনপিকে কুক্ষিগত করে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইছে—এমন অভিযোগের বিষয়ে কৃষক দল নেতা শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘কেউ কেউ হতাশা থেকে এ কথা বলে থাকতে পারেন। তবে অঙ্গসংগঠন হিসেবে আমার দায়িত্ব দলকে গতিশীল করা।’ আলমগীর কবিরকে ভালো মানুষ উল্লেখ করে শহীদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘উনি ফেস্টুন দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোয় দোষের কিছু দেখি না। তবে উনি ফরিদপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচন করবেন এ চিন্তা আমি করি না। বড় দলে একটি আসনে চার–পাঁচজন মনোনয়ন চাইতে পারেন। এটি দোষের কিছু নেই।’