খুলনার কয়রা উপজেলা ঘেঁষে বয়ে গেছে শাকবাড়িয়া নদী। নদীর এক পাশে সুন্দরবন, অন্য পাশে জনপদ। গত ১ জুন থেকে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বন বিভাগ। তবে সুন্দরবন আর লোকালয়কে আলাদা করা শাকবাড়িয়া নদীতে চলাচলে বাধা নেই।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে পৌঁছে গেলাম শাকবাড়িয়া নদীতীরবর্তী কাটকাটা গ্রামের লঞ্চঘাটে। সেখান থেকে তিনজন বনজীবী জেলের সঙ্গে শাকবাড়ীয়া নদীতে ছোট একটি ডিঙিতে চড়ে বসি। কাটকাটা গ্রামের ইসহাক আলী, আল-আমিন ও জহিরুল ইসলামের সঙ্গে গল্পে গল্পে এগোতে থাকে নৌকা। সবাই বংশপরম্পরায় সুন্দরবনের কাঁকড়া ও মাছ সংগ্রহের সঙ্গে যুক্ত। সুন্দরবনের কিনার ঘেঁষে শাকবাড়িয়া নদী দিয়ে নৌকাটি চলতে থাকে।
নদীপাড়ের সুন্দরবনের হেতাল, বাইন, গেওয়া গোলপাতা আর কেওড়ার মিশেলে বনটি দেখতে অন্য রকম। উজান স্রোত হলেও বইঠা বেয়ে এগোতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না। স্রোত নেই বললেই চলে। এর মধ্যে চোখ আটকে যায় কেওড়াগাছের অপূর্ব সমারোহে। এক কিলোমিটারের মতো এলাকাজুড়ে শুধুই কেওড়াগাছ। সরু লম্বাটে সবুজ পাতার ফাঁকে থোকায় থোকায় গাছে ঝুলে থাকা অসংখ্য কেওড়া ফল দেখিয়ে জেলে ইসহাক আলী বলেন, ‘আমাদের কাছে বিরিয়ানি যেমন লোভনীয় খাবার, সুন্দরবনের হরিণ ও বানরের কাছে এই ফল (কেওড়া) তেমনই।’
ইসহাক আলী জানান, বনের ভেতরে দুই–এক দিন থাকলে চোখে পড়বে কেওড়া নিয়ে সুন্দরবনে হরিণের সঙ্গে বানরের বন্ধুত্বের দৃশ্য। হরিণের জন্য বানর গাছ থেকে কেওড়ার পাতা ও ফল নিচে ফেলে দেয়। আবার বাঘ হরিণ শিকারে এলে গাছের ওপরে থাকা বানর শিকারি বাঘকে দেখে মুখ দিয়ে একধরনের শব্দ করে নিচে থাকা হরিণকে সতর্ক করে দেয়। এ কারণে হরিণ অনেক সময় বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।
কেওড়া ফল দেখতে অনেকটা ডুমুরের মতো। সবুজ রঙের ফলের ওপরের মাংসল অংশটুকু টক স্বাদের। ভেতরে বেশ বড় বিচি। কাঁচা ফল লবণসহকারে খাওয়া যায়। কেওড়া ফল থেকে আচার ও চাটনি তৈরি করা হয়।
তবে সুন্দরবনের হরিণ আর বানরের উপাদেয় খাদ্য হলেও বহু বছর আগে থেকে মানুষের খাদ্য হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে কেওড়া। সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার মানুষ কেওড়া ফল বেশি খায়। কেওড়া ফল দেখতে অনেকটা ডুমুরের মতো। সবুজ রঙের ফলের ওপরের মাংসল অংশটুকু টক স্বাদের। ভেতরে বেশ বড় বিচি। কাঁচা ফল লবণসহকারে খাওয়া যায়। এ ফল দিয়ে তৈরি কেওড়াজল বিভিন্ন রান্নায়ও ব্যবহার হয়।
সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকার লোকজন কেওড়া ফলের সঙ্গে চিংড়ি ও মসুরের ডাল রান্না করে খেয়ে থাকে। তা ছাড়া কেওড়া ফল থেকে আচার ও চাটনি তৈরি করা হয়। আবার কেওড়া ফল পচে গেলে মৎস্যচাষিরা মাছের খাদ্য হিসেবেও একে ব্যবহার করে থাকেন। অন্যদিকে সুন্দরবনে উত্পন্ন মধুর একটা বড় অংশ আসে কেওড়া ফুল থেকে।
বইঠা বাইতে বাইতে জেলে জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘সুন্দরবনের মধ্যে জেলেরা দাওনে (বড়শিতে) কেওড়া গেঁথে দিয়ে বিশাল বিশাল পাঙাশ মাছ ধরে ফেলে।’ সেটা কেমন করে হয়? উত্তরে তিনি জানান, ‘প্রথমে পুষ্ট বা পাকা কেওড়া সেদ্ধ করা হয়। তারপর দাওনে (বড়শিতে) গেঁথে বনের নদীতে ফেলে। ভরা মৌসুমে এক দাওনে শতাধিক পাঙাশও ধরা পড়ে। বনের কালীর খাল, পাটকোস্টা, ছিচখালী, ভদ্রা এলাকায় পাঙাশ মাছ বেশি পাওয়া যায়।’
শাকবাড়িয়া নদীতে ভাসতে ভাসতে কিছু দূর এগোলে একটি বাঁক, যেখান থেকে বাঁয়ে মোড় নিয়ে খড়খড়িয়া খাল দিয়ে ঢুকে পড়া যায় সুন্দরবনের গহিনে। খালের মুখে জমাট বাঁধা কেওড়ার বন দেখছি আর জেলে জহিরুল ইসলামের সঙ্গে গল্প করছি। এ সময় জেলে আল-আমিন ডাক দিয়ে বলে উঠলেন, ‘সামনের গাছে একটা জিনিস দেখেন ভাই।’ তাকিয়ে দেখি, খড়খড়িয়া খালের কিনারে একটি কেওড়াগাছে অনেকগুলো বানর কেওড়া ফল খাচ্ছে। আমাদের দেখেই দুরন্ত এ প্রাণীগুলো গহিন জঙ্গলে পালিয়ে গেল।
ফাল্গুন মাসে কেওড়াগাছে ছোট ছোট হলুদ বর্ণের ফুল হয়। চৈত্র-বৈশাখে ফল ধরে এবং আষাঢ়-শ্রাবণ ও ভাদ্র-আশ্বিন পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়।
বনজীবী জেলে আল-আমিন বলেন, বানর আছে মানে কাছাকাছি হরিণও আছে। সুন্দরবনের যেখানে–সেখানে হরিণ খুঁজলে পাবেন না। কেওড়া বনের কাছাকাছি ওরা ঝাঁক বেঁধে থাকে। বাঘ বা মানুষের চাপ না থাকলে ওরা সারা দিনই এমন জায়গায় থাকতে পছন্দ করে। শুধু জোয়ারের পানি উঠলে সরে যায় উঁচু কোনো জায়গায়। আর শিকারিরা এই সময়কে কাজে লাগান। জোয়ারের সময় পানি উঠে গেলে বনের মধ্যে জায়গা কমে আসে। সরু হয়ে আসে ওদের চলাচলের পথ। জায়গামতো দড়ি দিয়ে বানানো হরিণ ধরার ডোয়া (ফাঁদ) পেতে রাখেন শিকারিরা। ডোয়ায় কখনো কখনো হরিণের সঙ্গে বন্য শুকরও আটকা পড়ে।
কিছুক্ষণ খড়খড়িয়া খালের মুখে নৌকা থামিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার পর জোয়ারের পানি নামতে শুরু করলে আমরা আর সামনে না এগিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। ফেরার পথে জেলেরা জানান, ফাল্গুন মাসে কেওড়াগাছে ছোট ছোট হলুদ বর্ণের ফুল হয়। চৈত্র-বৈশাখে ফল ধরে এবং আষাঢ়-শ্রাবণ ও ভাদ্র-আশ্বিন পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়।
সুন্দরবনের কেওড়াগাছের ফল বিক্রি আইনত দণ্ডনীয়। তবে বাণিজ্যিকভাবে কেওড়ার চাষ করলে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার মানুষের জীবনযাত্রায় অর্থনীতির নতুন দিগন্তের সূচনা হতে পারে।এ জেড এম হাছানুর রহমান, সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক
লোকালয়ে ফিরে কথা হয় কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক বিদেশ রঞ্জন মৃধার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শুধু সুন্দরবনই নয়, চলতি মৌসুমে উপকূলীয় নদীর চরের গাছেও কেওড়ার ফলন হয়েছে অনেক। ফলে ফলে ভরে গেছে প্রতিটি গাছ। কেওড়া বর্ধনশীল হওয়ায় গাছে দ্রুত ফল ধরে। আমাদের সুন্দরবনঘেঁষা জনপদগুলোতে কেওড়া ফলের চাষ ও এর বাণিজ্যিকীকরণ হলে অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে। এখন কয়রার হাটবাজারেও কেওড়া ফল কিনতে পাওয়া যাচ্ছে।’
সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, সুন্দরবনের কেওড়াগাছের ফল বিক্রি আইনত দণ্ডনীয়। তবে বাণিজ্যিকভাবে কেওড়ার চাষ করলে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার মানুষের জীবনযাত্রায় অর্থনীতির নতুন দিগন্তের সূচনা হতে পারে। জোয়ার-ভাটা হয়, এমন চরভরাটি জমিতে যদি বাণিজ্যিকভাবে কেওড়া চাষ করা হয়, তাহলে বাঁধ ও পরিবেশ এবং বন্য প্রাণী সংরক্ষণের পাশাপাশি এর কাঠ ও ফল বাজারে বিক্রি করে লাভবান হওয়া সম্ভব।