রাসেলের বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন তাঁর কৃষিশ্রমিক বাবা মো. ফজলুল মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর ছোট্ট রাসেলকে নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন মা রাশেদা বেগম। অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনোমতে কাটত মা-ছেলের দিন। রাসেলের ছয় বছর বয়স হওয়ার পর তাকে পঞ্চগড় সরকারি শিশু পরিবারে (বালক) ভর্তি করে দেন রাশেদা বেগম। ২০১৩ সালের কথা সেটি। এর কিছুদিন পরই অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায় রাশেদা বেগমের। এর পর থেকেই যোগাযোগ কিছুটা কমে যায় মা-ছেলের। মাঝেমধ্যে রাশেদা বেগম শিশু পরিবারের মুঠোফোনে কল দিয়ে কথা বলেন ছেলে রাসেলের সঙ্গে। তবে মায়ের কাছে আর যাওয়া হয় না রাসেলের।
১০ বছর ধরে সরকারি শিশু পরিবারের বেড়ে ওঠা রাসেল ইসলাম (১৬) এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। প্রায় ১০ বছর ধরেই সরকারি শিশু পরিবারেরই ঈদ করছে রাসেল।
গতকাল বুধবার দুপুরে পঞ্চগড় সরকারি শিশু পরিবারে রাসেলের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। এবারের ঈদ কেমন হচ্ছে, জানতে চাইলে খানিকক্ষণ থমকে যায় রাসেল। একটু চুপ থেকে নিজে থেকেই বলতে শুরু করে, ‘আগে ঈদ এলে খুব কষ্ট হতো। মাকে মনে পড়ত। এখন অনেক দিন হয়ে যাওয়ায় ঈদে তেমন আর কষ্ট হয় না। কষ্টটা সয়ে গেছে। এখানে আমরা যারা থাকি, সবাই একটা পরিবারের মতো। সবাই মিলে এখানেই আনন্দ করি। প্রতিবছর ঈদে আমাদের এখান থেকেই নতুন কাপড় দেয়। এবারও ঈদে আমাদের নতুন শার্ট-প্যান্ট দিয়েছে।’
আগে ঈদ এলে খুব কষ্ট হতো। মাকে মনে পড়ত। এখন অনেক দিন হয়ে যাওয়ায় ঈদে তেমন আর কষ্ট হয় না। কষ্টটা সয়ে গেছে। ঈদের দিন অনেক অভিভাবক এসে এখানকার শিশুদের নিয়ে যাবে। কিন্তু আমি যাব না। কোথায় যাব? শুনেছি, মায়ের যেখানে বিয়ে হয়েছে সেখানে নাকি ছেলে-মেয়ে হয়েছে। মা যেতে বলে, কিন্তু আমি কখনো যাই না।রাসেল ইসলাম, পঞ্চগড় সরকারি শিশু পরিবারের নিবাসী কিশোর
ঈদের পর মায়ের কাছে যাবে কি না, প্রশ্নে রাসেল বলে, ‘ঈদের দিন অনেক অভিভাবক এসে এখানকার শিশুদের নিয়ে যাবে। কিন্তু আমি যাব না। কোথায় যাব? শুনেছি, মায়ের যেখানে বিয়ে হয়েছে সেখানে নাকি ছেলে-মেয়ে হয়েছে। মা যেতে বলে, কিন্তু আমি কখনো যাই না।’
শুধু রাসেলই নয়, প্রতিবছরের মতো বাবা-মাকে ছাড়া এবারও ঈদ করবে পঞ্চগড় সরকারি শিশু পরিবারে থাকা ৪৪ শিশু। কেউ বাবাহারা, কেউ মাহারা এসব শিশুর মধ্যে অনেকের অভিভাবক ঈদের দিন বিকেলে ছুটি নিয়ে বাড়িতে নিয়ে গেলেও কারও কারও যাওয়ার জায়গা না থাকায় সেখানেই থাকবে বলে জানা গেছে।
গতকাল দুপুরে পঞ্চগড় সরকারি শিশু পরিবারে গিয়ে দেখা যায়, ঝলমলে রোদের মধ্যে শিশু পরিবার চত্বরটি গাছপালার ছায়ায় ঘেরা। সুন্দর পরিপাটি পরিবেশে মাঠের এক পাশে ঈদ উপলক্ষে জবাই করা হয়েছে ছাগল। সেখানে শিশু পরিবারের শিশু-কিশোরেরাসহ ভিড় করছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা। এসব দেখাশোনা করছেন শিশু পরিবারের উপতত্ত্বাবধায়ক মো. আবদুর রাকিব। শিশু-কিশোরদের কেউ কেউ আবার জোহরের নামাজের প্রস্তুতি হিসেবে যাচ্ছে গোসলে। শেষ রমজানের দিন বলে সবার মনেই ঈদের আনন্দ।
মিলন নামে আমার এক চাচাতো ভাই আছে। সে মাঝেমধ্যে আমার খবর নেয়। এবার এখানে বড় ভাইদের সঙ্গে ঈদ করব। মাও নাই, বাবাও নাই, কার কাছে ঈদ করব। এখানে ঈদে নতুন শার্ট, প্যান্ট আর জুতা পাইছি। ঈদের পর চাচাতো ভাই মিলন আমাকে নিতে এলে তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাব।সোহাগ হোসেন, পঞ্চগড় সরকারি শিশু পরিবারের নিবাসী শিশু
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পঞ্চগড় জেলা শহরের মিঠাপুকুর এলাকায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত চারতলা ভবনের পঞ্চগড় সরকারি শিশু পরিবারে (বালক) মোট ৯০ জন শিশুর আসন রয়েছে। এর মধ্যে ৬১ জন ভর্তি থাকলেও নিয়মিত থাকে ৪৪ জন। ৬ থেকে ৯ বছর বয়সী পিতৃহীন শিশুরা সেখানে ভর্তি হতে পারে। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানে থেকে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পায় শিশুরা।
জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার বুড়াবুড়ি এলাকায় বাড়ি শিশু সোহাগ হোসেনের (৮)। মাত্র তিন বছর বয়সে মারা যান মা শাহনাজ পারভীন। এর পর থেকে ট্রাকচালক বাবা ও চাচা-চাচিদের কাছে বড় হতে থাকে সোহাগ। দুই বছর আগে মারা যান বাবা কবীর হোসেন। এরপর গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর স্বজনেরা সোহাগকে ভর্তি করে দেন সরকারি শিশু পরিবারে। সেখান থেকেই স্থানীয় ডোকরোপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে সে। শিশু পরিবারে সোহাগের এবারই প্রথম ঈদ। সোহাগ বলে, ‘মিলন নামে আমার এক চাচাতো ভাই আছে। সে মাঝেমধ্যে আমার খবর নেয়। এবার এখানে বড় ভাইদের সঙ্গে ঈদ করব। মাও নাই, বাবাও নাই, কার কাছে ঈদ করব। এখানে ঈদে নতুন শার্ট, প্যান্ট আর জুতা পাইছি। ঈদের পর চাচাতো ভাই মিলন আমাকে নিতে এলে তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাব।’
শিশু পরিবারে থাকা আরেক শিশু মাহফুজ হক বলে, ‘আমাদের বাড়ি আটোয়ারী উপজেলা তোড়িয়া এলাকায়। দুই বছর আগে আমার বাবা ঢাকায় করোনায় মারা যায়। এর পর থেকে মায়ের কাছেই ছিলাম। পরে মা নানির কাছে রেখে সৌদি আরবে কাজ করতে যান। এক বছর তিন মাস হলো আমাকে এখানে ভর্তি করে দিয়েছে। এবার মা-বাবা ছাড়াই এখানে ঈদ করব। শুনেছি ঈদের দিন নানি আমাকে নিতে আসবে।’
এখানে থাকা শিশুরা আমার পরিবারের একটা অংশ। এবার ঈদে সরকারি মেনু অনুযায়ী তারা ঈদের দিন সকাল ৭টায় ভুনা খিচুড়ি খাবে। ঈদের নামাজের পর দেওয়া হবে পর সেমাই ও মুড়ি। দুপুরে তাদের পোলাও, খাসির রেজালা ও কোমল পানীয় দেওয়া হবে।মো. আবদুর রাকিব, উপতত্ত্বাবধায়ক, পঞ্চগড় সরকারি শিশু পরিবার
দুপুরে শিশু পরিবারে বেড়াতে এসেছিলেন সেখানকার প্রাক্তন সদস্য হযরত আলী। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় আমার বাবা মারা গিয়েছিল। আমি ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এখানে থেকে পড়াশোনা করেছি। এরপর ২০২২ সালে আমার পুলিশে চাকরি হয়েছে। আমরা একসঙ্গে যে ১০ জন বের হয়েছি, তার মধ্যে তিনজনই পুলিশে চাকরি পেয়েছি। ঈদের ছুটিতে এসে প্রাণের প্রতিষ্ঠানে ছোট ভাইদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। মঙ্গলবার প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা মিলে এখানে সবাইকে নিয়ে ইফতারের আয়োজন করেছিলাম। ছোট ভাইদের সঙ্গে সময় দিতে পেরে ভালো লাগছে।’
শিশু পরিবারের মেট্রন কাম নার্স শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এটা আমাদের একটা পরিবার। ছোট্ট শিশুদের নিয়ে এখানেই ঈদ উদ্যাপন করব। ওদের জন্য সব আয়োজন করতেছি। এখানে সবার প্রতি সবার যে ভালোবাসা, এর জন্যই শিশুরা অতীতের কষ্টগুলো প্রায় ভুলে গেছে।’
পঞ্চগড় সরকারি শিশু পরিবারের উপতত্ত্বাবধায়ক মো. আবদুর রাকিব বলেন, ‘এখানে থাকা শিশুরা আমার পরিবারের একটা অংশ। আমি সার্বক্ষণিক তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করি। এবার ঈদে সরকারি মেনু অনুযায়ী তারা ঈদের দিন সকাল ৭টায় ভুনা খিচুড়ি খাবে। ঈদের নামাজের পর দেওয়া হবে পর সেমাই ও মুড়ি। দুপুরে তাদের পোলাও, খাসির রেজালা ও কোমল পানীয় দেওয়া হবে।’