গনগনে সূর্যটা যেন আগুন ঢালছে কুচকুচে কালো পিচে। ঘরের বাইরে বেরোলেই গায়ে ফোস্কা পড়ার জো। কাজ ছাড়া লোকে পারতপক্ষে ঘর ছেড়ে বের হন না। কিন্তু শ্রমজীবীদের ঘরে বসে থাকলে চলে না। জীবিকার তাগিদে তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যেও রাস্তায় নামতে হয় তাঁদের। দরদর করে ঘাম ঝরে। তবু উদয়াস্ত খাটেন মানুষগুলো। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কেউ কেউ হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হন।
তীব্র তাপপ্রবাহে ক্লান্ত–শ্রান্ত, খেটে খাওয়া মানুষ ও পথচারীদের সেবায় এগিয়ে এসেছেন অনেকে। ঢাকায় রেড ক্রিসেন্ট চালু করেছে কুলিং স্টেশন বা বিশ্রামাগার। রাজশাহী ও খুলনায় ব্যক্তি উদ্যোগে ও বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে পথচারীদের নিরাপদ পানি ও শরবত খাওয়ানো হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা।
৫০০–৬০০ বর্গফুট জায়গায় তাবু টানিয়ে কুলিং স্টেশন বা বিশ্রামাগার চালু করেছে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। তাদের ব্যানারে লেখা, ‘প্রচণ্ড গরমে স্বস্তি পেতে বিশ্রামাগারে আসুন।’ এ যেন তপ্ত মরুর বুকে শীতল ছায়ার সন্ধান। তৃষ্ণার্ত মানুষের হাতে এক বোতল পানি ধরিয়ে দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। ক্লান্ত–শ্রান্ত রিকশাচালক, ভ্যানচালকদের বিশ্রামাগারে বসে একটু জিরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করছেন।
জনা তিরিশেক মানুষের বসার ব্যবস্থা আছে একেকটি কুলিং স্টেশনে। আছে সাত থেকে আটটি ফ্যান। দুটি বিছানা পাতা আছে। নারী, শিশুদের জন্য আছে পৃথক ব্যবস্থা। একেকটি বিশ্রামাগারে আটজন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসার ধারণা আছে। জরুরি প্রয়োজনে প্রতিটি বিশ্রামাগারের পাশে একটি অ্যাম্বুলেন্সও রাখা আছে।
ঢাকায় মগবাজার চৌরাস্তা, ফার্মগেটে তেজগাঁও কলেজের উল্টো পাশে ও গুলিস্তান বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটে—এই মোট তিনটি বিশ্রামাগার আছে বলে জানালেন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সহকারী প্রকল্প ব্যবস্থাপক অভিষেক বড়ুয়া। গত ২৫ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত সাড়ে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ তাঁদের বিশ্রামাগার থেকে সেবা নিয়েছেন। এ রকম বিশ্রামাগার দেশের আরও ২০টি জেলা শহরে শিগগির চালু হবে বলে জানালেন অভিষেক।
তীব্র এই গরমে ঢাকা শহরে রেড ক্রিসেন্ট তাদের আরও কিছু সেবা চালু রেখেছে। বিভিন্ন ওয়ার্ডের জনসমাগমস্থলে পিকআপ ভ্যানে করে নিরাপদ পানি সরবরাহ, টুপি ও ছাতা বিতরণ এবং তীব্র গরম ও হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচতে জনসচেতনতার লক্ষ্যে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া তীব্র তাপপ্রবাহে প্রতিকূল অবস্থায় থাকা ঢাকায় বস্তি এলাকার ৪ হাজার পরিবারকে ৫ হাজার টাকা করে দিয়েছে রেড ক্রিসেন্ট।
তাপপ্রবাহে পুড়ছে খুলনাও। জনজীবনে নেমে এসেছে ভোগান্তি। নগরে শ্রমজীবী মানুষ ও পথচারীদের তৃষ্ণা মেটাতে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন ব্যক্তি। নিজেদের উদ্যোগেই ঠান্ডা পানি, শরবত, তরমুজ, শসা খাওয়াচ্ছে সাধারণ মানুষদের।
কয়েক দিন ধরে নগরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে শরবত, স্যালাইন, তরমুজ, শসা নিয়ে এসব সংগঠনের সদস্যদের বসতে দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে শ্রমজীবী মানুষ ও তৃষ্ণার্তদের মধ্যে তা বিতরণ করা হচ্ছে। এসব স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে যুক্ত আছে বিএনসিসি, খুলনা ব্লাড ব্যাংক, খুলনা বিএল কলেজের বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।
গত ৩০ এপ্রিল রাজশাহীতে ৫২ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। নগরের খেটে খাওয়া মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এ অবস্থায় বিভিন্ন সংগঠন এবং শিক্ষার্থীরা শরবত ও স্যালাইন নিয়ে খেটে খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
বুধবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ক্যান্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা বেলা সোয়া দুইটা থেকে সোয়া তিনটা পর্যন্ত লেবু শরবত বিতরণ করেছে। এ সময় তারা হাসপাতালের ট্রলিম্যান, অ্যাম্বুলেন্সের চালক, রিকশাচালক ও রোগীর স্বজনদের শরবত খাওয়ান।
একই দিন রাজশাহী কলেজ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে রাজশাহী কলেজের সামনে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিশুদ্ধ খাবার পানি, শরবত ও স্যালাইন বিতরণ করা হয়।
রিকশাচালক থেকে শুরু করে শ্রমজীবী—তাপপ্রবাহ থেকে রক্ষা পেতে নগরে প্রথম তাঁদের মধ্যে শরবত, পানি ও স্যালাইন বিতরণ করে ‘দ্য স্মাইলিং ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠন। গত ২১ এপ্রিল বেলা একটার দিকে নগরের সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট ও লক্ষ্মীপুর এলাকায় দুই শর বেশি পথচারীর মধ্যে তারা শরবত বিতরণ করে।
দিন কয়েক রাজশাহী মহানগরের বিভিন্ন জায়গায় রিকশাচালক, দিনমজুর ও ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের মধ্যে খাবার স্যালাইন, শরবত, বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করে ভাইব্রেন্ট ভিশনারিজ নেটওয়ার্ক। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সিফাত শাহারিয়ার বলেন, সবার উচিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে একে অপরকে সাহায্য করা।