নির্বাচন পর্যবেক্ষকের তালিকায় থাকা বরিশালের প্রতিষ্ঠানটি ‘নামসর্বস্ব’

নির্বাচন কমিশনে স্রাবন নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, এটি অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়
ছবি: প্রথম আলো

নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক হিসেবে বরিশালের যে প্রতিষ্ঠানটিকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, সেটি ‘নামসর্বস্ব’ একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির বরিশালে কোনো কার্যালয় খুঁজে পাওয়া যায়নি। তালিকাভুক্ত ‘সোসাইটি ফর রুরাল নিড’ (স্রাবন) নামে ওই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হিসেবে নাম উল্লেখ হয়েছে মো. আশরাফ হোসেন নামে এক ব্যক্তির। এর কার্যালয়ের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে বরিশালের হাসপাতাল রোডের ৩১৪ নম্বর বাসা। তবে গতকাল সোমবার রাতে ওই ঠিকানায় গিয়ে এই নামে কোনো কার্যালয় খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ভবনটির তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, ‘উত্থান’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামফলক। তবে সেটি তালাবদ্ধ। ভবনের তৃতীয় তলার এক ভাড়াটে নারী জানান, এখানে কয়েকজন লোক থাকেন। সামনে অফিসের নামফলক লাগানো আছে।

উত্থানের নামফলকে উল্লেখ করা মুঠোফোন নম্বরে কল করলে ফোন ধরেন আশরাফ হোসেন নামের এক ব্যক্তি। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, এখানে স্রাবন নামে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে কি না। তিনি বলেন, ‘আমি ওই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক।’ কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির কোনো সাইনবোর্ড নেই কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মূলত এটা আমাদের সাব–অফিস। আমাদের প্রধান কার্যালয় পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা সদরে। ফলে উত্থানের কার্যালয়েই আমরা স্রাবনের অফিসের কার্যক্রম চালাচ্ছি।’

বাউফল উপজেলা সদরের দাসপাড়ায় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় আছে বলে দাবি করেন আশরাফ হোসেন। তবে বাউফলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই প্রতিষ্ঠানটি নামসর্বস্ব একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে তারা পরিচিত কোনো প্রতিষ্ঠান নয় এবং তাদের লক্ষণীয় কোনো কার্যক্রমও নেই।

আশরাফ হোসেন দাবি করেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালের নির্বাচনেও পর্যবেক্ষক হিসেবে নির্বাচন কমিশনের তালিকাভুক্ত ছিল। ওই সময় তাঁরা ৩০০ পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছিলেন বলেও দাবি করেন।

তাঁর প্রতিষ্ঠানে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আশরাফ হোসেন বলেন, ‘না আমাদের তা নেই। কারণ, আমরা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম করি না। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ করি। বর্তমানে আমাদের কোনো প্রকল্প নেই।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বরিশাল নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিজেও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী। একই সঙ্গে প্রতিটি নির্বাচনেই আমরা সুজনের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করি। কিন্তু স্রাবন নামে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বরিশাল বা এই বিভাগে কাজ করে এমনটা আগে কখনো শুনিনি। এই প্রথম শুনলাম।’

নামসর্বস্ব এমন প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করানোর রেওয়াজ এবারই প্রথম নয়, উল্লেখ করে রফিকুল আলম বলেন, আগেও এমন নজির দেখা গেছে। বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে এমন নজির ছিল। এবারও কমিশন যেসব প্রতিষ্ঠানকে আগামী নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য তালিকাভুক্ত করেছে, সেগুলো বাস্তবে কোনো কার্যকর প্রতিষ্ঠান কি না কিংবা এদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, পরিচিতি, লোকবল আছে কি না, সেটি নিয়ে সংশয় আছে।

বাউফলে খোঁজ নিয়ে যা জানা গেল

মো. আশরাফ হোসেন তাঁর প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় বাউফল উপজেলার দাসপাড়া এলাকায় দাবি করার পর আজ দুপুরে ওই এলাকায় গিয়ে খোঁজ নেন প্রথম আলোর একজন প্রতিবেদক। এটি বাউফল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে দাসপাড়া ইউনিয়নের বাহির দাসপাড়া গ্রামে। সেখানে দেখা যায়, একতলা নির্মাণাধীন একটি বাড়ির সামনের ফটকে ছোট একটি সাইনবোর্ড টাঙানো। সাইনবোর্ড থাকলেও সেখানে কার্যালয় পরিচালনার কোনো আসবাব নেই। মূলত এটি আশরাফ হোসেনের পারিবারিক বসতঘর।

পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বাহির দাসপাড়া গ্রামে একটি বাড়ির মূল ফটকে একটি ছোট সাইনবোর্ড থাকলেও এখানে স্রাবন নামে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নেই। ছবিটি আজ মঙ্গলবার দুপুরে তোলা

স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি বলেন, এখানে এনজিওর কোনো কার্যক্রম তাঁরা কখনো দেখেননি। এমনকি আশরাফ হোসেনের কোনো এনজিও আছে বলেও তাঁরা কেউ জানেন না।

স্রাবন নামের এই সংস্থার যে ওয়েবসাইটের ঠিকানা দেওয়া আছে, সেটিতে ক্লিক করল ‘সাসপেন্ড’ দেখাচ্ছে। তবে এনজিও পোর্টাল নামে অপর একটি ওয়েবসাইটে সংস্থাটির কার্যক্রম সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘অর্থনৈতিক সামঞ্জস্য, জাতিগত সমতা, লিঙ্গ ভারসাম্য সুরক্ষিত শিক্ষা সুবিধা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং স্বাস্থ্যসচেতনতার পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে একটি স্থিতিশীল ইকো-সিস্টেমের মধ্যে একটি জনসংখ্যাগত এবং শিক্ষিত সমাজে সম্ভাব্য মানবসম্পদকে পুষ্ট করা।’

দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির বাউফল উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও প্রকৌশলী ফারুক তালুকদার মহিলা কলেজের শিক্ষক মো. আবদুল জলিল তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্রাবন নামে কোনো এনজিওর অস্তিত্ব বাউফলে আছে, এটা আপনার মাধ্যমে এই প্রথম শুনলাম। সে ক্ষেত্রে ওই এনজিওর পরিচালককে চেনার সুযোগ নেই।’