স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলায় দীপাবলি ও কালীপূজা উপলক্ষে প্রায় আড়াই শ বছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলার আয়োজন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে উপজেলা প্রশাসন ও পৌরসভা।
মেলা আয়োজনের ইজারাদার আকবর হোসেন সরদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় আড়াই শ বছর ধরে কুন্ডুবাড়ির মেলা হয়ে আসছে। কেউ কোনো দিন কোনো প্রশ্ন তোলেনি। কিন্তু এবার প্রশাসনের কাছে ইসলামী আন্দোলনের নেতা ও আলেম সমাজের প্রতিনিধিরা কিছু অভিযোগ তুলে লিখিত দিয়েছেন। কিন্তু তারা (নেতারা) আমার কাছে এসে বলেছে, হিন্দুদের মেলায় মুসলমানরা যাবে না। তাই এখানে মেলা করা যাবে না। আমাকে তারা মেলা না করার জন্য নিষেধ করেছে। এদিকে আমি পৌরসভা থেকে মেলার ইজারা নিয়ে কয়েক শ দোকানির কাছে জায়গা বরাদ্দ দিয়েছি। এসব দোকানি ঋণ করে মালামাল মেলায় বিক্রি করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। এখন এই মেলা না হলে এসব দোকানি ঋণের জালে জড়িয়ে পড়বেন। আমারও আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতি হবে।’
উপজেলা প্রশাসন, আয়োজক ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব দীপাবলি ও কালীপূজা। এই উৎসব ঘিরে কালকিনি উপজেলার ভূরঘাটা এলাকায় ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ি মেলার আয়োজন করা হয়। প্রায় ২৫০ বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী এই মেলা অনুষ্ঠিত হলেও এবার স্থানীয় ১২ জন ব্যক্তি ৯টি কারণ উপস্থাপন করে মেলাটি বন্ধের দাবি জানান। পরে কালকিনি পৌরসভা ও উপজেলা প্রশাসন সভা করে গত বৃহস্পতিবার এই মেলা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
একই সূত্রে আরও জানা গেছে, গত ১ এপ্রিল পৌরসভার পক্ষ থেকে ৮০ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যে আকবর হোসেন সরদার নামের আওয়ামী লীগের এক নেতাকে মেলা আয়োজনের ইজারা দেওয়া হয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে আওয়ামী লীগের নেতার ওই ইজারা বাতিলের দাবি জানায় একটি মহল। পরে সেটি করতে ব্যর্থ হলে তারা ৯টি কারণ দেখিয়ে মেলা পুরোপুরি বন্ধ করতে কালকিনি পৌরসভা ও প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ জানায়। পরে প্রশাসন অনেকটা চাপের মুখেই মেলাটি বন্ধের নির্দেশনা দেয়।
ভূরঘাটা কুন্ডুবাড়ি কালীপূজা উদ্যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিমল কুন্ডু প্রথম আলোকে বলেন, ‘কালীপূজা ঘিরেই এই মেলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের জিনিসপত্র ওঠে। হাজারো দোকানপাট বসে। লাখো মানুষের সমাগম ঘটে। এটি দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী মেলা। এই মেলা বন্ধ করতে রাতের আঁধারে কিছু মানুষ ব্যানার টাঙিয়ে মেলা বন্ধের ঘোষণা দিয়ে গেছে। এটা দেখে আমরা অবাক। আমাদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ প্রশাসন থেকে কেউ করেনি। আমরা এ ঘটনায় আতঙ্কিত ও মর্মাহত।’
কালকিনি পৌরসভার প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উত্তম কুমার দাশ প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় কয়েকজন এই মেলার বিভিন্ন সমস্যা উল্লেখ করে স্থায়ী বন্ধ করার জন্য লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তাঁদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সব ধরনের ঝামেলা এড়াতে কালকিনি পৌরসভা ও উপজেলা প্রশাসন এবার মেলার আয়োজন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ওই ১২ জন ব্যক্তির দেওয়া লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রতিবছর এই মেলায় মারামারি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া জুয়া, মদ ও গাঁজার আড্ডা, নারী ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, সামাজিক অবক্ষয় ও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। এসব কারণে এই মেলা তাঁরা বন্ধের দাবি জানান। অভিযোগপত্রে ১২ জন স্বাক্ষর করেছেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো।
ভূরঘাটা বাজার মসজিদের ইমাম ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যারা মেলাটি বন্ধের দাবি জানিয়েছি, তারা বেশির ভাগই ইসলামী আন্দোলনের কর্মী। আমরা শুনেছি, কুন্ডুবাড়ির মেলায় অপ্রীতিকর অনেক কিছুই ঘটে। স্থানীয়রা আমাদের জানিয়েছে। তাই আমরা মেলা বন্ধের দাবি জানিয়েছি। তবে মেলা যে হতে পারবেই না, হতে দেব না, এমন দায়িত্ব আমরা নিইনি।’
নয়টি অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কালকিনি কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম ও অভিযোগকারী গোলাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থানীয় মানুষের অভিযোগ আমরা তুলে ধরেছি। স্থানীয়দের থেকে যা শুনব, আমরা তো তাই বলব। কারও নাম আমরা শনাক্ত করতে চাই না।’ অভিযোগের সত্যতা যাচাই–বাছাই করেছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন কেটে দেন।
জানতে চাইলে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মোছা. ইয়াসমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেলা সংস্কৃতির অংশ। আর যেহেতু কুন্ডুবাড়ির মেলাটি ঐতিহ্যবাহী, তাই মেলাটি বন্ধের পক্ষে নয় জেলা প্রশাসন। মেলাটি বন্ধ চেয়ে যারা আবেদন করেছে, তাদের নিয়ে আমরা আলোচনায় বসে সমাধান করার চেষ্টা করব।’