শক্তিহীন পা নিয়ে প্রীতিলতার এগিয়ে চলা, এইচএসসিতে পেলেন জিপিএ-৫

পড়ালেখা করে ভালো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন প্রীতিলতা সাহা। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মোস্তবাপুরে গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

বাঁকা দুই পায়ে কোনো শক্তি নেই। আছে মনের বল। ছোটবেলায় প্রীতিলতা স্কুলে যেতেন নানার কাঁধে চড়ে। একটু বড় হলে নানার সাইকেলের পেছনে বসে। কলেজে উঠতে উঠতে নানার মৃত্যু হলে প্রীতিলতার পথচলার সঙ্গী হয় হুইলচেয়ার। পাশে পান মা আর বান্ধবীদের। এভাবেই গ্রামের কলেজে পড়াশোনা করে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন তিনি।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মোস্তবাপুরে গ্রামে মায়ের সঙ্গে প্রীতিলতা সাহার (২০) বসবাস। এখন তাঁর আশা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন, সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবেন। পড়ালেখা শেষ করে ভালো মানুষ হবেন, একটা চাকরি করে ভূমিহীন বৃদ্ধা মায়ের পাশে দাঁড়াবেন।

প্রীতিলতার বাবা প্রয়াত প্রশান্ত সাহার বাড়ি ছিল যশোর সদর উপজেলার বারিনগর গ্রামে। মাত্র ৬ বছর বয়সে বাবাকে হারান প্রীতিলতা। এরপর মা সুজাতা সাহা তাঁকে নিয়ে চলে আসেন কালীগঞ্জের মোস্তবাপুরে নানার বাড়িতে। সেখানেই বেড়ে ওঠা প্রীতিলতার। গতকাল সোমবার বাড়িতে গিয়ে কথা হয় মা ও মেয়ের সঙ্গে।

নানার সাইকেলে চড়ে স্কুলে যাচ্ছে প্রীতিলতা সাহা

প্রীতিলতার মা সুজাতা সাহা বলেন, বিয়ের পর তাঁরা স্বামী-স্ত্রী ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ নেন। তাঁর দুই মেয়ে। বড় মেয়ে প্রিয়াংকা সাহাকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে প্রীতিলতার জন্ম থেকেই দুই পা বাঁকা। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। এ কারণে তাঁকে বাড়িতে রেখে যান। ঢাকায় চাকরিরত অবস্থায় ২০১১ সালে তাঁর স্বামী প্রশান্ত সাহা অসুস্থ হয়ে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর গ্রামের বাড়ির জায়গাটি হাতছাড়া হয়ে যায়। এ অবস্থায় তিনি চলে আসেন বাবার বাড়ি। এখানে প্রীতিলতাকে রেখে তিনি আবার ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজে যান।

ছোটবেলা থেকেই প্রীতিলতার পড়ালেখার প্রতি বেশি আগ্রহ। সেই আগ্রহের কারণে নানা শান্তি স্মরণ সাহা তাঁকে বাড়ির পাশে ফারাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। এরপর মোস্তবাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। শান্তি স্মরণ সাহা প্রথম দিকে কাঁধে করে তাঁকে বিদ্যালয়ে নিয়ে যেতেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাঁকে সহযোগিতা করতেন। কিছুদিন পর বাইসাইকেলে করে বিদ্যালয়ে নিয়ে যেতেন আবার নিয়ে আসতেন। এভাবে ২০২১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় প্রীতিলতা জিপিএ-৪.৮৬ পান। এরপর তিনি বাড়ির সবচেয়ে কাছের কলেজ শহীদ নূর আলী কলেজে ভর্তি হন।

মা সুজাতা সাহার সঙ্গে প্রীতিলতা সাহা

সুজাতা সাহা জানান, নানা শান্তি স্মরণ মারা যাওয়ার পর একা হয়ে পড়েন প্রীতিলতা। মায়ের ওপর নির্ভরতা বেড়ে যায়। তিনি বাড়ি চলে আসেন। মেয়েকে গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজে কাজে যান। মেয়ে কলেজের সামনে নামার পর বান্ধবীদের এগিয়ে দেওয়া হুইলচেয়ারে করে ক্লাস করতেন। এভাবে চারতলা ভবনে উঠে তাঁকে ক্লাস করতে হয়েছে।

সুজাতা সাহা বলেন, নিজেদের কোনো জায়গাজমি নেই। বসবাসের কোনো ঘরও নেই। তাঁর গ্রামের অগ্নি সাহা শহরে বাস করেন। তাঁর রেখে যাওয়া বাড়িতে তাঁরা থাকেন। নিজে দিন ২০০ টাকা চুক্তিতে একটি কারখানায় কাজ করেন। এই টাকায় চলে তাঁদের সংসার ও মেয়ের পড়ালেখা। সংবাদপত্রে লেখালেখির পর কিছু সহযোগিতা পেয়েছেন, যা মেয়ের পড়ালেখায় অনেক সহযোগিতা হয়েছে বলে জানান সুজাতা।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ২১ জুলাই প্রথম আলো পত্রিকায় ‘নানার সাইকেলের চাকা না ঘুরলে স্কুলে যাওয়া বন্ধ প্রীতিলতার’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন অনেকে। পাশে দাঁড়ান কেউ কেউ।
প্রীতিলতার কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যক্ষ রাশেদ সাত্তার বলেন, মেয়েটি মানবিক বিভাগের ছাত্রী আবার শারীরিক প্রতিবন্ধী। সেই হিসেবে ভালো ফল করেছেন। পড়ালেখার প্রতি তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। তাঁরা কলেজে পক্ষ থেকে সহযোগিতা করেছেন। শিক্ষকেরা তাঁকে প্রাইভেট পড়িয়ে পয়সা নেননি, কালীগঞ্জবাসীও অনেকে তাঁর সহযোগিতা করেছেন। মেয়েটির মনের জোর রয়েছে। তাঁরা আশা করছেন, প্রীতিলতা আরও ভালো কিছু করতে পারবেন।

প্রীতিলতা সাহা বলেন, কষ্ট করে পড়ালেখা করে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন। এখন চিন্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন। তাঁর ভাবনা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে ট্রেনে চেপে যেতে পারবেন। অন্য যানবাহনে যাওয়া তাঁর পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়বে।