শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত গোদাগাড়ী ও তানোরের কৃষক

ঈদের আগে ধান পাকলেও ওই সময় কৃষকেরা শ্রমিক পাননি। এতে তাঁদের সর্বনাশ হয়েছে।

শিলাবৃষ্টিতে গাছ থেকে ঝরে গেছে ধান। গতকাল গোদাগাড়ী উপজেলার কাকন হাটের দরগাপাড়া এলাকায়

১৫ মিনিটের শিলাবৃষ্টিতে রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলায় ফসলের খেত তছনছ হয়ে গেছে। প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকার কোথাও ৪ কিলোমিটার, কোথাও ২ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে ফসলের ক্ষতি হয়েছে। গত বুধবার বিকেলে ওই ঘটনা ঘটে।

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা বলছেন, রেলগাড়ির মতো মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটে গেছে শিলাবৃষ্টি। যেদিক দিয়ে গেছে, সর্বনাশ করে গেছে। ডানে-বাঁয়ে তেমন কিছুই হয়নি। ধানখেত হয়ে গেছে খড়ের খেত। শিলাবৃষ্টি হওয়ার তিন দিন পরও কৃষকেরা জমিতে ঝাড় দিয়ে ঝরা ধান তোলার চেষ্টা করছেন। আমগাছ থেকে অবশিষ্ট আম এখনো ঝরছেই।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বুধবার সারা দিন কাঠফাটা রোদ ছিল। বিকেলের দিকে হঠাৎ গোদাগাড়ী উপজেলার কাঁকনহাট পৌর এলাকার পশ্চিম দিকের মাঠ পাঁচগাছিতে শিলাবৃষ্টি শুরু হয়। প্রায় ১৫ মিনিটের মধ্যে সেই বৃষ্টি পূর্ব দিকে সুন্দরপুর, শেরাপাড়া, হাটপাড়া, দরগাপাড়া, কাঁকনপাড়া পার হয়ে আরও পূর্ব দিকে উপজেলার রিশিকুল ইউনিয়নের মান্ডইল গ্রামের একাংশের ওপর দিয়ে উত্তর দিকে সাহাপুর, বাবুপুর, কোশিয়া হয়ে রাজশাহীর তানোর উপজেলার চান্দুড়িয়া গিয়ে হালকা হয়ে শেষ হয়ে যায়। গ্রামগুলোর ভেতর দিয়ে চলে শিলাবৃষ্টি। এ ছাড়া মান্ডইলের পূর্ব পাশে রিশিকুল ইউনিয়নের ভানুপুর ও পার্শ্ববর্তী পবা উপজেলার তিশলাই গ্রাম ও কাঁকনহাটের পাঁচগাছির উত্তর দিকে রসুলপুর, কুমেদপুর ও দিঘিপাড়া এলাকাতেও এর প্রভাবে ফসলের ক্ষতি হয়েছে।

গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মরিয়ম আহমেদ বলেন, আকস্মিক এই শিলাবৃষ্টিতে ১১০ হেক্টর ফসলের ক্ষতি হয়েছে। পাকা ধানের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। তাঁরা চাষিদের পাকা ধান তাড়াতাড়ি কেটে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে চাষিরা বলছেন, ঈদের আগে ধান পাকলেও ওই সময় তাঁরা শ্রমিক পাননি। এতে তাঁদের সর্বনাশ হয়েছে। তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহম্মদ বলেন, তাঁদের ৫০ হেক্টর ফসলের ক্ষতি হয়েছে।

গতকাল শনিবার দুপুরে গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট পৌর এলাকার দরগাপাড়া এলাকায় ঢুকতেই দেখা যায়, বাগানে আমগাছের নিচে কাঁচা আম পড়ে মাটি ঢেকে গেছে। খেতে ধানগাছ শুধু দাঁড়িয়ে আছে, শিষ থেকে ধান ঝরে পড়ে রয়েছে মাটিতে। তার পাশের মহাদেবপুর গ্রামের একটি ধানের শিষেরও ক্ষতি হয়নি।

দরগাপাড়ায় দেখা যায়, রইস কিসকু ও তাঁর স্ত্রী সুমিতা টুডু শুধুই ধানের খড় কাটছেন। রইস বললেন, জমিটা পরিষ্কার করতে হবে। আর খড়টা গরুর খাবার হবে। সেই জন্যই কাটতে হচ্ছে। তাঁর পাশের জমিটা শুকনা ছিল। শিলার আঘাতে ঝরে পড়া ধানের খেতের মাটিতে সোনালি রঙের হয়ে আছে। কাঠফাটা রোদের মধ্যে কোহিনুর বেগম ঝাঁটা হাতে সেই ধান কুড়িয়ে বস্তায় তুলছেন। তিনি বলেন, তাঁর স্বামী মারা গেছেন। তাঁকেই সংসার সামলাতে হয়। এবার সাত কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। ধানের এ অবস্থা হয়েছে।

ধানগাছকে খড় হিসেবে কেটে নেওয়ার জন্য খেতে শ্রমিক লাগিয়েছেন দরগাপাড়া গ্রামের গোলাম রাব্বানি। তিনি বললেন, ২৫ কাঠা জমিতে তাঁর বোরো ধান ছিল। চাষাবাদে খরচ হয়েছিল ১৮ হাজার ৫০০ টাকা। এখন খড় কাটতে আরও সাড়ে চার হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। ধানের জন্য নয়, গরুর খাবারের জন্য বাড়তি এই খরচ করতে হচ্ছে।

পাশেই দেখা গেল জাহিদ নামের এক কৃষক শিলাবৃষ্টির দুই দিন আগে ধান কেটে মাঠেই শুকানোর জন্য রেখেছিলেন। তার ওপর শিলাবৃষ্টি হয়ে মাঠেই ঝরে পড়েছে সব। জমিতে পানি জমে গেছে। তিন দিন পরও তিনি সেই ধান আর তুলতে আসেননি। কাঁকনপাড়ার মাঠে ইবলুল হাসানের পাঁচ বিঘা জমিতে ধান ছিল। তিনি বলেন, ১৫ মিনিটের শিলাবৃষ্টিতে সব শেষ করে দিয়ে গেছে। ধান আগেই পেকেছিল। কিন্তু ঈদের আগে ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছিল না। শ্রমিক পেলে তাঁর এই সর্বনাশ হতো না।

রসুলপুর মাঠে কৃষক আতাউর রহমান ২১ বিঘা ধান ও ৭ বিঘা জমিতে ভুটা চাষ করেছিলেন। এখন মাঠে শুধু ধানের খড় আর ভুট্টার ডাঁটা খাড়া রয়েছে। তিনি বলেন, তাঁর ভুট্টার জমি পুরোটাই বর্গা নেওয়া আর ধানেরও অর্ধেক বর্গা জমি। এই শিলাবৃষ্টি তাঁকে শেষ করে দিয়েছে।

দরগাপাড়ার রোকেয়া বেগমের ১১টি গাছে আর আম নেই। শিলাবৃষ্টির পর যা বাকি ছিল, তা এখন ঝরে যাচ্ছে। সেই আম আর কুড়াতেও পারছেন না। তিনি বললেন, ‘কত কুড়হাবে, দোহার (পুনরায়) পইড়ছে।’

দরগাপাড়ার মোড়ে কৃষক নাঈমুল ইসলাম বললেন, ‘সার-বিষের বাকি লিয়্যা চিন্তায় আছি। সরকার অনুদান না দিলে হাঁরা আর খাড়াইতে পাইরব না।’