বিক্রির জন্য সেদ্ধ ডিম নিয়ে বসে আছেন গৃহবধূ হাসিনা। ১৩ নভেম্বর রাত সাড়ে ১২টার দিকে গাজীপুর নগরের স্টেশন রোড এলাকায়
বিক্রির জন্য সেদ্ধ ডিম নিয়ে বসে আছেন গৃহবধূ হাসিনা। ১৩ নভেম্বর রাত সাড়ে ১২টার দিকে গাজীপুর নগরের স্টেশন রোড এলাকায়

১৫ বছর ধরে পথে পথে ডিম বিক্রি করেন হাসিনা

বিয়ের প্রথম কয়েক বছর দিনমজুর স্বামীর আয়ে বেশ ভালোই চলছিল গৃহবধূ হাসিনার সংসার। ধীরে ধীরে বড় হয় সংসার। বাড়ে খরচ। হাঁপিয়ে ওঠেন তাঁর দিনমজুর স্বামী। সংসারের বাড়তি খরচ সামলাতে বাধ্য হয়ে পথে পথে সেদ্ধ ডিম বিক্রি করতে নামেন হাসিনা। প্রায় ১৫ বছর ধরে ডিম বিক্রি করে চলেছেন তিনি।

গৃহবধূ হাসিনার বাড়ি ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলা এলাকায়। বর্তমানে গাজীপুর নগরের মাছিমপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। তাঁর স্বামী আবুল কাশেম পেশায় দিনমজুর। বিয়ের কয়েক বছর পরই তাঁরা জীবিকার তাগিদে টঙ্গীর পূর্ব থানা-সংলগ্ন মাছিমপুর বস্তিতে ঠাঁই নেন। সেখান থেকে আবুল কাশেম দিনমজুরির কাজ শুরু করেন। কিন্তু বাসাভাড়া, দুই মেয়ের লেখাপড়াসহ অন্যান্য খরচ কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। প্রায়ই কাজ থাকত না কাশেমের। এসব কারণে সংসারে টানাপোড়েন দেখা দেয়।

হাসিনার ভাষ্য, বাধ্য হয়ে মানুষের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নেন তিনি। পরে একজনের পরামর্শে নগরের পথে পথে ডিম বিক্রি শুরু করেন তিনি। এভাবেই প্রায় ১৫ বছর ধরে ডিম বিক্রি করে সংসার সামলাচ্ছেন।

১৩ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টার দিকে হাসিনার সঙ্গে দেখা হয় গাজীপুর নগরের স্টেশন রোড এলাকায়। রাস্তাঘাট ফাঁকা। চারদিক নির্জন। হাসিনা বসে আছেন সড়কবাতির নিচে একটি প্লাস্টিকের টুলে। সামনে একটি অস্থায়ী চুলা। চুলার ওপর একটি পাত্রে ৮ থেকে ১০টি সেদ্ধ ডিম। দুয়েকজন পথিককে হেঁটে আসতে দেখলেই একটি কাঠি দিয়ে একধরনের শব্দ করে ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন তিনি। এরপরও কেউ ডিম না কিনলে মন খারাপ হচ্ছে তাঁর।

অনেকে কোনো ডিম বেচা না অইলে ফ্রিজে রাইখ্যা পরের দিন বেচে। কিন্তু আমি এইড্যা করি না। বেচা না অইলে নিজের লস হয়, তাও মানুষরে খারাপটা খাওয়াই না।
হাসিনা, সেদ্ধ ডিম বিক্রেতা
হাসিনার কাছ থেকে ডিম কিনে নিচ্ছেন এক ক্রেতা। ১৩ নভেম্বর মধ্যরাতে গাজীপুর নগরের স্টেশন রোড এলাকায়

এর মধ্যেই এক যুবককে হেঁটে যেতে দেখে হাসিনা হাঁক দিয়ে বললেন, ‘মামা, একটা ডিম খাইয়্যা যান, আর মাত্র কয়ডা ডিম বাকি। এগুলা বেচা না অইলে চালান উডব না।’ ওই যুবক ঘুরে দাঁড়ালেন। একটি ডিম কিনলেন। এবার খেতে খেতে হাসিনার কাছে যুবকের জিজ্ঞাসা, ‘রাত বাজে সাড়ে ১২টা, বাসায় যাবেন কখন? একা যেতে ভয় করবে না?’ হাসিনার জবাব, ‘গরিব মাইনষ্যের ডর-ভয় থাকন নাই। ডর লইয়্যা বইয়্যা থাকলে সংসার চলব না।’

হাসিনা বলেন, প্রতিদিন নির্দিষ্টসংখ্যক সেদ্ধ ডিম নিয়ে তিনি রাস্তায় বের হন। তিনি প্রতিদিন বিকেল ৪টায় বের হয়ে ডিম বিক্রি শুরু করেন। কখনো রাত ১২টা বা তারও বেশি সময় পর্যন্ত ডিম বিক্রিতে ব্যস্ত থাকেন। এ থেকে যে আয় হয়, তা দিয়ে টেনেটুনে সংসার চলে।

হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘড়ির কাঁটায় সময় রাত ১২টা ২৫ মিনিট। এখনো হাসিনার চারটি ডিম অবিক্রীত। মোটামুটি ক্রেতার আশা ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু চারটি ডিম কী করবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে হাসিনা বললেন, ‘এহন আর কিছু করার নাই, এইগুলা নিজেগোরই খাইতে অইব। অনেকে কোনো ডিম বেচা না অইলে ফ্রিজে রাইখ্যা পরের দিন বেচে। কিন্তু আমি এইড্যা করি না। বেচা না অইলে নিজের লস হয়, তাও মানুষরে খারাপটা খাওয়াই না।’