সুনামগঞ্জ শহরে জরুরি রক্তের প্রয়োজন হলে অনেকের মনে প্রথম যে নামটি আসে তিনি হলেন মুজাহিদুল ইসলাম (৪৬)। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে ‘ব্যবস্থা একটা হবেই’ বলে ধারণা অনেকের। তিনি নিজে রক্তদাতা, রক্ত জোগাড় করে দেন এবং মানুষকে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহিত করেন। ২৮ বছর ধরে এই মহৎ কাজে যুক্ত তিনি।
সুনামগঞ্জে বর্তমানে স্বেচ্ছায় রক্তদান করার প্রবণতা বাড়ছে। স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে তরুণ-তরুণীদের সংখ্যাই বেশি। তাঁরা সব সময় বিপদে-আপদে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করছেন।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের হাসননগর এলাকার বাসিন্দা মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ১৯৯৪ সালে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের এক শিক্ষকের রক্তের জরুরি প্রয়োজন হয়। তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু রক্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন সেখানে মুজাহিদুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। একপর্যায়ে ওই শিক্ষক মারা যান। বিষয়টি সবাইকে নাড়া দেয়।
এরপর সরকারি কলেজের শিক্ষক মোহাম্মদ আবদু মিয়ার নেতৃত্বে সুনামগঞ্জে সন্ধানী ডোনার ক্লাবের কার্যক্রম শুরু হয়। সেই থেকে তিনি স্বেচ্ছায় রক্তদাতা এবং এই কাজের সংগঠক। এ পর্যন্ত ৫৬ ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন তিনি নিজে। তাঁর পরিবারের আট ভাই-বোনের সবাই স্বেচ্ছায় রক্তদাতা। সবাই মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৫০০ ব্যাগের মতো রক্ত দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
মুজাহিদুল বলেন, ‘একসময় আমার কাছে একটা তালিকা ছিল। রক্তের প্রয়োজন হলেই লোকজন যোগাযোগ করতেন। এখনো করেন। তবে এখন আমি বাঁধনসহ অন্যান্য সংগঠনের বন্ধুদের সহযোগিতা নিয়ে থাকি।’
তরুণ সোহানুর রহমান (২৫) স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধন সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ সংগঠক ও সাবেক সভাপতি। এ পর্যন্ত ১৭ বার রক্ত দিয়েছেন। সোহান বলেন, প্রথম দিন রক্ত দিয়ে বাড়িতে যাওয়ার পর মা জেনে খুব রাগ করেছিলেন। পরে আরও দুয়েকবার এমনটা হয়েছে। একসময় যখন তিনি বুঝতে পারেন রক্ত দিলে কোনো ক্ষতি নেই, তখন আর ছেলেকে বাধা না দিয়ে বরং এই মহৎ কাজে উৎসাহ দেন।
নিয়মিত রক্ত দেন, এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় এখানে স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার বিষয়ে মানুষের মধ্যে অনাগ্রহ ছিল। মানুষেরা সচেতন ছিলেন না। এখন সেটা নেই। প্রয়োজনে রক্ত পাওয়া যায়। তবে সুনামগঞ্জে ব্লাড ব্যাংক থাকলে আরও ভালো হতো। কেউ রক্তের প্রয়োজনে কোনো একটি সংগঠনের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করলে সবাই মিলে সেটার ব্যবস্থা করে দেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কাজটি সহজ করে দিয়েছে।
বর্তমানে সুনামগঞ্জে সন্ধানী ডোনার ক্লাব, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, বাঁধন, ব্লাডলিংক, খিদমাহ, বিশ্বজন, আলোসহ আরও কয়েকটি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করছেন। এ ক্ষেত্রে এখন সক্রিয় বেশি শিক্ষার্থীদের সংগঠন বাঁধন ও পেশাজীবীদের সংগঠক ব্লাডলিংক। এসব সংগঠনের সদস্যরা স্বেচ্ছায় রক্তদানের পাশাপাশি নতুন রক্তদাতা তৈরি, রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের কাজ করে থাকেন।
সোহানুর আরও বলেন, বাঁধন সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে গঠিত হয় ২০১৭ সালে। বাঁধন এ পর্যন্ত ২ হাজার ৯৫ ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করেছে। নতুন ৫৪৯ জন রক্তদাতা তৈরি করেছে। সংগঠনের উদ্যোগে ৮ হাজার ১২৯ জনকে বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করে দিয়েছে।
সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তাজিন হক এ পর্যন্ত সাতবার রক্ত দিয়েছেন। একই কলেজের সম্মান দ্বিতীয় আরেক বর্ষের শিক্ষার্থী ফারজানা আক্তার কাজ করেন একটি স্বেচ্ছায় রক্তদাতা সংগঠনের হয়ে। রক্তের প্রয়োজনে অনেকেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
ফারজানা বলেন, ‘একজন মানুষকে যখন আপনি রক্ত দেবেন বা তাঁর জন্য রক্ত সংগ্রহ করে দেবেন, তখন কী যে ভালো লাগে, সেটি বলে বোঝানো যাবে না। আপনার রক্তে অন্য একজনের প্রাণ বাঁচছে, এটি ভাবতেই ভালো লাগে।’
সুনামগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে কোনো ব্লাড ব্যাংক নেই। তবে রক্ত পরিসঞ্চালনের ব্যবস্থা আছে। বছরে এখানে ৫০০ থেকে ৫৫০ ব্যাগ রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয়।
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, যেকোনো সুস্থ ব্যক্তি প্রতি তিন মাস পর প্রয়োজনে রক্ত দিতে পারেন। এতে কোনো সমস্যা নেই।