গভীর গর্ত করে বালু তোলার ফলে পাড় ভাঙছে নদীর। প্রায় দুই শ বিঘা জমিতে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে।
দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলায় আত্রাই নদে বলদিয়াপাড়া বালুমহালে খাস কালেকশনের নামে বালু বিক্রির টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে সাবেক দুই ইজারাদারের বিরুদ্ধে। ঘাটের বালু বিক্রির টাকা নামমাত্র সরকারি কোষাগারে জমা দিচ্ছেন।
এদিকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে গভীর গর্ত করে বালু তোলার ফলে পাড় ভাঙছে নদীর। প্রায় দুই শ বিঘা জমিতে ব্যাহত হচ্ছে বোরো ধান, মিষ্টিকুমড়া ও পেঁয়াজের আবাদ। এ ছাড়া ডাম্প ট্রাক চলাচলের কারণে প্রায় এক কিলোমিটার পাকা রাস্তা ভেঙে গেছে। বালু পরিবহনে ডাম্প ট্রাক বন্ধের দাবিতে একাধিকবার মানববন্ধন করেছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা।
ওই ঘাটে প্রতিদিন ৬৫-৭০ হাজার টাকার মাল (বালু) বিক্রি সম্ভব। খরচা বাদে তো এক ভাগ টাকা থাকে।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, এক বালু ব্যবসায়ী
ওই দুই ইজারাদার হলেন রুবেল ইসলাম ও নুর আলম। রুবেল স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং নুর আলম আলোকঝাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বাংলা ১৪২৯ সনে এক কোটি দুই লাখ টাকায় বলদিয়াপাড়া বালুমহালটি ইজারা দিয়েছিল বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটি। সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে ইজারা পেয়েছিলেন রুবেল ইসলাম। পরের বছর ১৪৩০ সনে ইজারার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলে রুবেল ইসলাম দর দেন ৫০ লাখ। সরকার নির্ধারিত মূল্য কম হওয়ায় ঘাট ইজারা দেয়নি প্রশাসন। দ্বিতীয়বার প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে ৩০ লাখ এবং সর্বশেষ ২৬ অক্টোবর তৃতীয়বারের মতো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে ১৫ লাখ টাকা দর দেন রুবেল। তিনবারই অন্য কেউ দরপত্র দাখিল করেননি। অগত্যা বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০-এর ১১ ধারা (সংশোধনী ২০২৩) অনুযায়ী কমিটি ওই বালুমহাল থেকে খাস আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয়।
নিয়ম অনুযায়ী সরকারি অফিস কর্তৃক নির্ধারিত ব্যক্তি (তহশিলদার) খাস আদায় করবেন। কিন্তু বলদিয়াপাড়া বালুমহালে সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির বদলে খাস আদায় করছেন সাবেক ইজারাদার রুবেল ইসলাম ও তাঁর সহযোগীরা।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, গত দুই মাস প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০টি ডাম্প ট্রাক ও ৩০টির অধিক ট্রলিতে বালু পরিবহন করা হচ্ছে। একটি ডাম্প ট্রাকভর্তি বালু ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং ট্রলিভর্তি বালুর মূল্য ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময়ে সরকারি কোষাগারে দৈনিক ৭১ হাজার ৫০০ টাকা হিসাবে মোট ৪২ লাখ ৯০ হাজার টাকা জমা হওয়ার কথা। তবে বীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলে এলাহী জানান, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে দেড় লাখ টাকার কিছু বেশি।
দিনাজপুরের ওপর দিয়ে প্রবহমান আত্রাই নদ। নদের পূর্বে খানসামা উপজেলার আলোকঝাড়ি গ্রাম, পশ্চিমে বীরগঞ্জ উপজেলার গড়ফতু গ্রাম। দুই গ্রামের মধ্যবর্তী জায়গায় বলদিয়া পাড়া বালুমহাল। গত মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘাট ঘুরে দেখা যায়, পূর্ব-পশ্চিমে দুটি খননযন্ত্র বসিয়ে গভীর গর্ত করে পাইপের সাহায্যে বালু ঢিবি করা হচ্ছে। নদের মাঝবরাবর লম্বালম্বি রাস্তা বানানো হয়েছে। এক্সকাভেটর দিয়ে ডাম্প ট্রাকে লোড হচ্ছে বালু। সেই বালু যাচ্ছে দিনাজপুরসহ পার্শ্ববর্তী জেলা-উপজেলা শহরে।
বেলা ১১টা থেকে এক ঘণ্টায় চারটি ডাম্প ট্রাকে বালু নিয়ে যেতে দেখা যায়। যদিও ঘাটের বাঁধে টংঘরে বসে থাকা ব্যবস্থাপক মাহবুর রহমান বলেন, ‘ব্যবসা নাই। সারা দিন দুই-একটা গাড়ি লোড হয়। পাশেই আরও দুটি ঘাট থেকে বালু উত্তোলন করায় বলদিয়াপাড়া ঘাটে গাড়ি ঢুকছে কম।’ আলাপচারিতার এক ফাঁকে তাঁর টেবিলে সাদা ও গোলাপি রঙের দুই ধরনের স্লিপ দেখা যায়। যার একটিতে লেখা মেসার্স রুবেল ট্রেডার্স-টোল আদায়ের রসিদ, অন্যটিতে লেখা খাস আদায়ের রসিদ।
লোকবলের সংকট থাকায় কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। আগের ইজারাদারই কালেকশন করছেন।ফজলে এলাহী, ইউএনও, বীরগঞ্জ
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বালু ব্যবসায়ী বলেন, ঘাট চলে সাত-আট মাস। ঘাটের ইজারা মূল্য বেশি হওয়ায় একটা ‘সিন্ডিকেট’ করা হয়েছে। এ কারণে ডাকে কেউ অংশ নেননি। একজন অংশ নিলেও মূল্য কম দিয়েছেন। সরকার পড়েছে বেকায়দায়। এখন খাস কালেকশনে গেছে। তা-ও আবার সরকারি কোনো লোক নেই। বাধ্য হয়ে ইজারাদারের মাধ্যমে কালেকশন করছে। বলেন, ‘ওই ঘাটে প্রতিদিন ৬৫-৭০ হাজার টাকার মাল বিক্রি সম্ভব। তিন ভাগের দুই ভাগ টাকাও যদি খরচা ধরেন, তারপরও তো এক ভাগ টাকা থাকে। শুনতেছি ইউএনওর সাথে সমন্বয় করে বর্তমান ইজারাদার ঘাট চালাচ্ছেন।’
এদিকে ঘাট এলাকায় বোরো ধান রোপণ করছিলেন কৃষক মহসীন আলী (৪০)। তিনি বলেন, ‘প্রায় ১০০ বিঘা জমিতে স্থানীয় ব্যক্তিরা ধান ও কুমড়া আবাদ করতাম। এইবার আবাদ করা নিষেধ। খানসামা-বীরগঞ্জের এসি ল্যান্ড (সহকারী কমিশনার) ও নুর আলম মেম্বার (সাবেক) মিলে বালুটা বিক্রি করছেন। ড্রেজার লাগিয়ে ৩০ ফিট গর্ত করে বালু তোলা হচ্ছে। ৫০ বিঘা খেত ভেঙে গেছে।’
চরে ১০ কাঠা জমিতে পেঁয়াজ লাগিয়েছেন কৃষক জসিমউদ্দীন (৭০)। মঙ্গলবার সকালে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে খেতে নিড়ানি দিচ্ছিলেন। জসিমউদ্দিন বলেন, ‘জাগা নাই। কী করব? আবাদ করির দেয় না। এবার সরকার থাকি গমের বীজ দিল কিন্তু লাগাইতে দিল না।’
এসব অভিযোগ সম্পর্কে রুবেল ইসলাম মুঠোফোনে জানান, তিনি ইউএনওর কাছ থেকে ঘাট চালানোর অনুমতি নিয়েছেন। যদিও এ বিষয়ে কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। তিনি বলেন, ব্যবসা তেমন নেই। এ পর্যন্ত দুই লাখের মতো টাকা জমা দিয়েছেন। ঘাট চালাতে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, কুলি শ্রমিক অফিসসহ নানা জায়গায় টাকা দিতে হয়। তবে কৃষকদের আবাদ করতে নিষেধ করার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
এ বিষয়ে বীরগঞ্জের ইউএনও ফজলে এলাহী বলেন, ‘আমি কোনো বক্তব্য দেব না। তবে তথ্য নিতে পারেন।’ এ সময় তিনি বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির রেজল্যুশনের কপি দেখান। খাস কালেকশনে সরকারি জনবল না থাকার বিষয়ে বলেন, সাধারণত তহশিলদার এই কাজ করেন। লোকবলের সংকট থাকায় কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। আগের ইজারাদারই কালেকশন করছেন।