সিভিল সার্জন কার্যালয়ের হিসাবমতে, সিলেটে ১৪৮ জন থ্যালাসেমিয়া রোগী আছেন। এর মধ্যে নগরের অভ্যন্তরে রয়েছেন ২২ জন।
সিলেটের একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন জলিলুর রহমান। তাঁর এক মেয়ে ও এক ছেলে। ছোট ছেলে (১২) বর্তমানে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। ছেলের যখন দেড় বছর বয়স, সে সময় তাঁর ছেলে অসুস্থ হয়ে যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানতে পারেন, ছেলে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি তাঁর স্ত্রী এবং বড় মেয়ের রক্ত পরীক্ষা করান। তখন জানতে পারেন, তাঁরা তিনজনই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। এরপর ছেলেকে রক্ত দেওয়া শুরু করেন। প্রথম দিকে এক মাস পরপর দিলেও বর্তমানে ছেলেকে ২১ দিন পরপর রক্ত দিতে হচ্ছে।
জলিলুর বলেন, বিভিন্ন সংগঠন এবং পরিচিতজনদের মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করেন। এরপরও প্রতিবার রক্ত দিতে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা খরচ হচ্ছে। রক্ত জোগাড় করতে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। আজ থ্যালাসেমিয়া দিবস শুনে তিনি বলেন, এ দিবসে সবার কাছে কিছু বার্তা দেওয়া জরুরি। বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত।
এ বাস্তবতায় আজ বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস পালন করা হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের উদ্যোগে শোভাযাত্রা এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
সিলেট সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৪৮ জন থ্যালাসেমিয়া রোগীর তালিকা রয়েছে তাঁদের কাছে। এর মধ্যে নগরের অভ্যন্তরে রয়েছেন ২২ জন।
* এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগে এ রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। * তিন বছরে প্রায় তিন হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজিস্ট মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড নেই। মেডিসিন বিভাগে সাধারণত এ রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। হাসপাতালে গত তিন বছরে প্রায় তিন হাজার রোগী এ রোগের চিকিৎসা নিয়েছেন।
নাজমুল ইসলাম বলেন, এ রোগের বিষয়ে সচেতনতার বিকল্প নেই। হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া শনাক্তের পরীক্ষা হয় না। তবে পরীক্ষার ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি হেমাটোলজি বিভাগ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের বহির্বিভাগে সপ্তাহে দুই দিন হেমাটোলজির চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
ছাতকের বাসিন্দা বশর আলীর ১২ ও ১১ বছর বয়সের দুই মেয়ে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। মাসে তাদের দুই ব্যাগ রক্ত নিতে হয়। এরই মধ্যে মেয়েদের চিকিৎসায় তাঁর ১০ লাখ টাকার মতো খরচ হয়ে গেছে। দিনমজুর বশর আলীর পক্ষে অন্যের সহযোগিতা ছাড়া এত টাকা খরচ করা সম্ভব ছিল না। তিনি বলেন, প্রতি মাসে দুই মেয়ের রক্ত নেওয়ার সময় সাত–আট হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
সিলেটে ২০১৬ সাল থেকে ‘মানবতার ডাক’ নামে স্বেচ্ছাসেবী রক্ত সরবরাহকারী সংগঠন পরিচালনা করেন নুরুল করিম। ২০০৭ সাল থেকে তিনি নিজে রক্তের স্বেচ্ছাসেবী এবং রক্তদাতা হিসেবে কাজ করছেন। এ সংগঠনে শতাধিক সদস্য রয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে ১০ জন থ্যালাসেমিয়া রোগী এবং স্বজনেরা নিয়মিত যোগাযোগ করেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেকে সক্রিয়। ‘সেফটি সোশ্যাল অর্গানাইজেশন’ নামের সংগঠনের অ্যাডমিন মুজিবুর রহমান বলেন, ২০১৭ সালে তাঁদের ফেসবুকভিত্তিক এ সংগঠন যাত্রা শুরু করে। এর সদস্যসংখ্যা ৬০। প্রায় ৭০ জন থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীকে তাঁরা রক্ত সরবরাহ করেন।
সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন জন্মেজয় দত্ত বলেন, মা-বাবা থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলে সন্তানের এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য দুই বাহকের মধ্যে বিয়ের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। সিলেটে থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে এককালীন অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। সহায়তার জন্য চিকিৎসকের কাছ থেকে প্রত্যয়ন প্রয়োজন হয়। সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে এ জন্য সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হয়।